যৌন হয়রানির দায়ে প্রধান শিক্ষক জেলহাজতে, বরখাস্ত করেনি সভাপতি !

প্রকাশিত: ৪:০২ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৪

বর্তমান খবর,রাজশাহী প্রতিনিধি: ‘২০০৯ সালেও যৌন হয়রানির অভিযোগে তাকে জেলে যেতে হয়েছিল। ২০২৩ সালেও তার বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ ওঠে। বাকশিমইল উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক থাকাকালে যৌন হয়রানির অভিযোগে তাকে জেল খাটতে হয়েছে। তবে জেলা আওয়ামীলীগের ক্ষমতাধর নেতা হওয়ায় সে সময় এবং এসময় তাকে সাময়িক বহিস্কার করা হয়নি।

রাজশাহীর মোহনপুরে যৌন হয়রানির অভিযোগে একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে অবরুদ্ধ করে উত্তম মধ্যম দিয়েছে ছাত্র ছাত্রীরা। তার অপসারণ চেয়ে স্কুল প্রাঙ্গণে জড়ো হয়ে বিক্ষোভও করে তারা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত হন অভিভাবকরাও।

গত ২ অক্টোবর রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার ধুরইল উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেনীর তিন ছাত্রীর সংগে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠে। বিষয়টি অভিভাবকরা বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আক্কাস আলীকে জানালেও তিনি প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন কার্যকরী ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাকে বাঁচাতে মরিয়া হওয়ায় সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুসে উঠেন ছাত্র ছাত্রী ও তাঁর অভিভাবকসহ স্থানীয়রা।

গত ১৫ অক্টোবর ২০২৩ রোববার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের হাতে অবরুদ্ধ থাকেন প্রধান শিক্ষক সোহরাব আলী খাঁন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে বেলা ১টার দিকে উপস্থিত হন স্থানীয় চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন, মোহনপুর থানা পুলিশ, সহকারী কমিশনার ভূমি মিথিলা দাস, একাডেমিক সুপার ভাইজার আব্দুল মতিন। তাঁরা শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে অভিযুক্ত শিক্ষককে অপসারণসহ আটকের ঘোষনা দিলে বিক্ষোভ স্থগিত করেন ছাত্র ছাত্রীরা। পুলিশ প্রধান শিক্ষককে আটক করে থানায় নিয়ে যান। পরে এক ছাত্রী অভিভাবক বাদি হয়ে থানায় মামলা দায়ের করলে সোহরাব আলীকে জেল হাজতে প্রেরণ করে মোহনপুর থানা পুলিশ।

এরপর তিনি আদালত থেকে জামিন নেন ৷ থানা পুলিশ তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিলে রাজশাহী নারী-শিশু আদালত (মোহনপুর) ২৮ জানুয়ারী রোববার ওই শিক্ষকের জামিন বাতিল করে আবারো কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সেই থেকে জেল হাজতে রয়েছে ওই প্রধান শিক্ষক।

তবে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে এর আগেও একাধিক অভিযোগ ছিল। সে জেলা আওয়ামীলীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি সাবেক মেম্বার আক্কাস আলীর একান্ত ঘনিষ্ঠ লোক। একারণে ঘটনার চার মাস অতিবাহিত হলেও জেলে থাকা অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষককে বরখাস্ত না করে তাকে বাঁচানোর সকল চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন সভাপতি আক্কাস আলী এমন অভিযোগ করেন শিক্ষার্থী অভিভাবকরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অষ্টম শ্রেনীর এক ছাত্রী বলেন, প্রধান শিক্ষক ‘ সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীকে তার অফিসে ডেকে নিয়ে তার কোলে বসিয়ে ছবি তোলেন। বিভিন্ন সময়ে ছাত্রীদের স্পর্শকাতর অঙ্গ স্পর্শ করেন। বিভিন্ন ছাত্রীকে তার কক্ষে একা দেখা করতে বলেন। তার কথা না শোনলে তাকে ফেল করারও হুমকি দেন।

স্কুলটিতে দুই শত ষাট জন ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে। সোহরাব আলী নানা সময় একাধিক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করেছেন বলে অভিযোগ তাদের। বিষয়গুলো স্কুলের সভাপতি, অন্যান্য শিক্ষক, কর্মচারী, এমনকি এলাকার লোকজনও জানে বলেও উল্লেখ করেন ওই ছাত্রী। সে বলে,‘ প্রধান শিক্ষক আওয়ামীলীগ নেতা হওয়ায় তাঁর ভয়ে কেউ মুখ খোলেনা। সভাপতি প্রধান শিক্ষকের কথায় সভাপতি আক্কাস তার কথায় উঠে ও বসে।

প্রধান শিক্ষক অবরুদ্ধের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এস এম মাহমুদ হাসান তদন্ত শেষে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে প্রধান শিক্ষক সোহরাব আলী খাঁন যৌন হয়রানির সাথে জড়িত এবং তার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সুপারিশ করেন।

উল্লেখ্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাকশিমইল উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মরত কয়েকজন শিক্ষক জানান, সোহরাব আলী খাঁন ২০০৯ সালে বাকশিমইল উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক থাকাকালে নবম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির ঘটনায় একই সালের মার্চ মাসে ১০/১২দিন জেল হাজতে ছিলেন। বর্তমান মোহনপুর সরকারি কলেজ অধ্যক্ষ ও উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক মফিজ উদ্দিন কবিরাজের সরাসরি হস্তক্ষেপে সে সময় তাকে বরখাস্ত করতে পারেনি উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তিনি তদন্ত প্রতিবেদন পরিবর্তন করে সে ঘটনায় সোহরাব আলী খাঁনকে বাঁচিয়ে দেন বলেও জানান শিক্ষকরা।

এবিষয়ে ধুরইল উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোঃ আব্দুল লতিফ জানান, সভাপতি ফোন করেছিল আজকালের মধ্যে প্রধান শিক্ষককে সাময়িক বহিস্কার করা হবে।

এ বিষয়ে মোহনপুর থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এস এম মাহমুদ হাসান জানান, তিনি ধুরইল উচ্চ বিদ্যালয়ের ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তার কাছে এখন পর্যন্ত কেউ লিখিত অভিযোগ করেননি। প্রধান শিক্ষককে বহিস্কার প্রসঙ্গে তিনি জানান, এবিষয়ে আমার কিছুই করার নাই। সবকিছুই সভাপতি করবেন। যেহেতু আপনারা আসছেন সভাপতিকে ডেকে নিয়ে বিষয়টি আমি দেখছি।

এবিষয়ে মোহনপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আয়শা সিদ্দিকা বলেন, ধুরইল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সোহরাব আলী খাঁনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে প্রতিবেদন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো হয়েছে।

এবিষয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার নাসির উদ্দিন বলেন, যেহেতু প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সেহেতু বিষয়টি আদালতের ব্যাপার। তাছাড়া এটা ম্যানেজিং কমিটি দেখবে।