ইতিহাসের অমূল্য দলিল বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক

প্রকাশিত: ১২:৩৩ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১, ২০২৩

বর্তমান খবর,তাপস হালদার : বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির মহানায়কই নন, তিনি সারা বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত, অধিকার বঞ্চিত মানুষের মহানায়ক। এমন একজন ব্যক্তিত্বের পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে তাঁকে সম্পূর্ণরূপে ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। পরিচালক শ্যাম বেনেগাল ‘মুজিব-একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে অত্যন্ত মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে বায়োপিক ‘মুজিব- একটি জাতির রূপকার’ সিনেমাটি গত ১৩ অক্টোবর সারাদেশে ১৫৩টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। ২৭ অক্টোবর ভারতে হিন্দি ভাষায় এবং পরবর্তীতে সারা বিশ্বে ইংরেজি ভাষায় মুক্তি পায়। গত ১২ অক্টোবর আগারগাঁও বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে সিনেমাটির প্রিমিয়ার প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি ছোট বোন শেখ রেহানা, স্বজন শিল্পী, কলাকুশলী ও দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে ছবিটা দেখেন। এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘এই চলচ্চিত্র থেকে ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য সম্পর্কে জাতি জানতে পারবে। আমার পরিবার, মা-বাবা সম্পর্কে জানতে পারবে। যে ইতিহাস কখনো শোনেননি তাও উঠে এসেছে এই সিনেমায়।’

বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত সিনেমায় ব্যয় হয়েছে ৮৩ কোটি টাকা। মোট ব্যয়ের বাংলাদেশ ৬০ শতাংশ ও ভারত ৪০ শতাংশ ব্যয় করেছে। ২০২১ সালের ২২ জানুয়ারি শূটিং শুরু হয়ে একটানা ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। মুম্বাইয়ের দাদাসাহেব ফালকে ফিল্ম সিটিতে সিনেমার শূটিং হয়। সেখানে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া, কলকাতার বেকার হোস্টেল, মিছিল-মিটিংয়ের জায়গা, জেলখানা তৈরি করা হয়েছিল। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে টুঙ্গিপাড়া ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু দৃশ্য ধারণ করা হয়। চলচ্চিত্রটি বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি এই তিন ভাষায় ডাবিং করা হয়েছে।

২০২২ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে চলচ্চিত্রটির প্রথম পোস্টার, ৩ মে দ্বিতীয় পোস্টার ও ১৯ মে ৭৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘মুজিব-একটি জাতির রূপকার’ সিনেমাটির ট্রেলার প্রদর্শিত হয়েছিল। ১ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের ট্রেলারে বঙ্গবন্ধুর পুরো জীবনের এক ঝলক তুলে ধরা হয়। ট্রেলার দেখে অনেকেই সমালোচনা করেছিল। তখনই পরিচালক শ্যাম বেনেগাল বলোছিলেন, ট্রেলার দেখে পুরো সিনেমা সম্পর্কে মন্তব্য করা ঠিক নয়।

পরিচালকের কথাই সত্য হয়েছে। সিনেমাটা মুক্তির পর সব শ্রেণির মানুষের মুখেই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। অনেকেই হাউমাউ করে কেঁদেছেন এবং প্রত্যেক দর্শকের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিগুলো বারবার আলোড়িত করেছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আগেও সিনেমা হয়েছে। কোনোটাই বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক ছিল না। এভাবে পূর্ণাঙ্গরূপে কখনো বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরা হয়নি। ‘মুজিব একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্রেই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে পূর্ণাঙ্গভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সিনেমাটি আন্তর্জাতিক মানদন্ডে তৈরি। শুধু বাংলাদেশ নয়, বাংলা ভাষায়ই এমন ছবি এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি।

‘মুজিব-একটি জাতির রূপকার’ সিনেমাটি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়। বিমান থেকে নেমে বাংলার মাটিতে মাথা স্পর্শ করে মহামানব যে যাত্রা শুরু করেছিলেন সেটি দেখানো হয়। তিনি লাখো জনতার উপস্থিতিতে বাংলাদেশ পুনর্গঠনের ঘোষণা দেন। সিনেমায় উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর স্কুল জীবনে জাতীয় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং ছাদ সংস্কারের দাবি, কলকাতার বেকার হোস্টেলের জীবন, বিয়ে, বড় মেয়ে শেখ হাসিনার জন্ম, অন্য সন্তানদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা, ভাষা আন্দোলন, সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, ৬ দফা ও আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, রাজনৈতিক কারণে বারবার গ্রেপ্তার হওয়া, স্বাধিকার আন্দোলনে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ির গুরুত্ব¡,

’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি হায়েনাদের আত্মসমর্পণ, পাকিস্তানের কারাগারের পাশে বঙ্গবন্ধুর জন্য কবর খনন, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান প্রণয়ন, নির্বাচন, বাকশাল গঠন, শেখ কামাল ও শেখ জামালের বিয়ে, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার বিদেশ গমন এবং ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ঘটনার মধ্য দিয়ে টানা হয় সিনেমার পরিসমাপ্তি। শেষ দৃশ্যটিতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ঘটনা, শিশু রাসেলের বেঁচে থাকার আকুতি চরম পাষন্ডের চোখেও জল আনতে বাধ্য করবে। এমন মুহূর্তে পুরো প্রেক্ষাগৃহে যেন অন্ধকারের অমাবস্যা নেমে আসে। স্তম্ভিত হয়ে যায় দর্শক।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাষানী ভিন্ন দল করলেও বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর সানিদ্ধ্য ও আশীর্বাদ যে সবসময়ই ছিল সেটি সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বলতে শোনা যায় ‘বাংলাকে বাঁচাতে হইলে, মুজিবকে আগে বাঁচাইতে হইব। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক, সোহরাওয়ার্দীর কারণে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্রলীগের সদস্য হওয়া থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক যে অটুট ছিল সেটি দেখানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে তাজউদ্দীনসহ জাতীয় নেতাদের বিমানবন্দরে সংবর্ধনা, খন্দকার মোশতাকের চাটুকারিতা, শেখ কামাল-জামালের বিয়েতে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার যোগদান এবং খন্দকার মোশতাক ও জিয়ার গোপন যোগাযোগ সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

শ্যাম বেনেগালকে পরিচালক হিসেবে বাছাই করার কারণ তিনি মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ বসু ও সত্যজিৎ রায়ের জীবনী নিয়ে ছবি বানিয়েছেন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বই ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ অবলম্বনে ৫৩ পর্বের ধারাবাহিক তৈরি করেছেন। শ্যাম বেনেগাল সাতবার হিন্দি ভাষায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর প্রথম সিনেমা ‘অঙ্কুর’ ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দশটি সিনেমার একটি হিসেবে বিবেচিত। এসব বিবেচনায় তাঁকে পরিচালক হিসেবে নির্বাচন করা হয়। সহযোগী পরিচালক দয়াল নিহালানি।

চিত্রনাট্য লিখেছেন অতুল তিওয়ারি ও শ্যামা জায়েদি। শিল্প নির্দেশনা নীতিশ রায়, কস্টিউম ডিরেক্টর শ্যাম বেনেগালের মেয়ে পিয়া বেনেগাল। সিনেমার ‘অচিন মাঝি’ গানটি প্রতিটি দর্শকের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে। গানটিতে সুর করেছেন শান্তনু মৈত্র, কণ্ঠে রথীজিৎ এবং লিখেছেন জাহিদ আকবর। ‘কী কী জিনিস এনেছো দুলাল’ গানে কণ্ঠ দিয়েছেন উর্মি চৌধুরী।

চলচ্চিত্রে যেসব শিল্পী করেছেন তাদের প্রত্যেকেই একটি কথা বলেছেন, এই ছবিটিতে কাজ করে তাদের জীবন ধন্য হয়েছে। কারণ, এটি জাতির পিতাকে নিয়ে নির্মিত প্রথম বায়োপিক। সেজন্য এটিতে অভিনয় করা ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করার অনুভূতি জানিয়ে আরিফিন শুভ বলেছেন, ‘মুজিব সিনেমায় অভিনয় করার অভিজ্ঞতা বলে বোঝানোর মতো নয়। আমি মনে করি এটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ হয়ে থাকবে। এই সিনেমার পর আর কোনো কাজ না করলেও আমার আক্ষেপ থাকবে না।’ অন্যদিকে, ফজলুর রহমান বাবু বলেন, ‘এটি শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়- এটি একটি ইতিহাস।

আমি এ ইতিহাসের অংশ হয়ে রইলাম।’ শেখ হাসিনা চরিত্রে অভিনয় করা নুসরাত ফারিয়া বলেন, ‘এই ঘটনা আমার শিল্পীজীবন শুধু নয়, সমগ্র জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি। আর কোনোদিন অভিনয় না করলেও কোনো আফসোস থাকবে না।’ প্রত্যেক শিল্পীই বলেছেন, যে কোনো চরিত্রে অভিনয় করি না কেন, ইতিহাসের অংশ হতে পেরেছি, এতেই জীবন ধন্য।

পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসকে বিকৃত করে দীর্ঘ সময় এদেশের মানুষকে অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। আজকে মানুষ সত্য ইতিহাস জানার সুযোগ পাচ্ছে। সিনেমাটি নতুন প্রজন্মকে সত্য ইতিহাস জানার সুযোগ করে দেবে। যারা মিথ্যা ইতিহাস জেনে বড় হয়েছেন, তাদেরও ভুল ভাঙাবে। সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে, জনগণকে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে চলচ্চিত্রটি সহজে দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।

লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য,
সম্প্রীতি বাংলাদেশ