লোভনীয় অফারে স্বাস্থ্যঝুঁকি জেনেও তামাক চাষ করছে কৃষক

প্রকাশিত: ২:৪১ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ২১, ২০২৪

বর্তমান খবর,রংপুর ব্যুরো: তামাকজাত কোম্পানির লোভনীয় অফারে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট হয় এমন তথ্য জেনেও সপরিবারে তামাক চাষ করছে রংপুর বিভাগের নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও রংপুরের কৃষকগণ। গত বছরের চেয়ে চলতি মৌসুমে বেশী জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। তামাক চাষ যে স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি এমন তথ্য উপেক্ষা করে কোন আগ ঢাক না করেই রাস্তা বা জনবসতি এলাকায় তামাক পাতা শুকানো হচ্ছে।

এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের প্রতিরোধে নেই কোন তৎপরতা। অবাধে চলছে তামাক শুকানোর মহাউৎসব। কৃষকগণ পরিবার নিয়ে তামাক ক্ষেতে কাজ করছে। রংপুর সদর উপজেলার হরিদেবপুর ইউনিয়নের কৃষক বাদশারুল ইসলাম বলেন,চলতি বছর প্রায় চার বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছেন। কোম্পানি থেকে টাকা নিয়ে তামাক চাষ করা হয়েছে। অন্যান্য ফসল চাষে বীজ, সার, সেচসহ উৎপাদন খরচ বাড়ছে। তামাকজাত কোম্পানি তামাক চাষে নানা রকম সহায়তা করছে। যে কারণে ক্ষতি জেনেও তামাক চাষ করা হচ্ছে।

একটি নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা যায়, গত বছর যেসব জমিতে ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা ও আলুসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করা হয়েছিল, চলতি বছর সেই সব জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। তামাকজাত কোম্পানির প্রলোভন ও অধিক মুনাফার আশায় তামাক চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন কৃষকেরা। শুধু তাই নয়, কৃষি বিভাগের নিরবতায় কোথাও কোথাও প্রণোদনার সারেও তামাক চাষের অভিযোগ উঠেছে।

রংপুর সদর,গংগাচড়া,তারাগঞ্জ,বদরগঞ্জ,মিঠাপুকুর উপজেলার বিভিন্ন দেখা যায়,গত বছর যে জমিগুলোতে আলুসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন করা হয়। এবার চিত্র কিছুটা ভিন্ন। তামাকজাত কোম্পানিগুলোর সহায়তার কারণে বেড়েই চলেছে তামাকের আগ্রাসন। তবে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তামাক চাষ বন্ধে প্রশাসন কিছু পদক্ষেপ নিলেও মাঠ পর্যায়ে তেমন সাড়া মিলছে না।

একাধিক চাষি জানান, তামাক চাষে তাদের উৎসাহের নেপথ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, আকিজ টোব্যাকো, নাসির টোব্যাকো, আবুল খায়েরসহ বিভিন্ন তামাকজাত কো¤পানি রয়েছে। চাষ পূর্ববতী ও পরবর্তী বিশেষ সহায়তা দিয়ে থাকে এসব বহুজাতিক কো¤পানি। তামাক চাষে বীজ ও সার ক্রয়ের জন্য নগদ টাকাসহ উপকরণ সরবরাহ ও নিয়মিত তদারকি করে কোম্পানির প্রতিনিধিরা। এসব সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি দাম ভালো পাওয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি জেনেও তামাক চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা।

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর, বাছুরবান্ধা, জয়বাংলা, হাতীবান্ধা এলাকায় দেখা যায়, ধান, গম, ভুট্টা ও সরিষা ক্ষেতের পাশে তামাকে বিস্তৃত ফসলি জমি। ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছে চাষিরা। আর সময় মতো উৎপাদিত তামাক বুঝে নিতে মাঠে তদারকি করছেন চুক্তিবদ্ধ তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিরা।

বাছুরবান্ধা গ্রামের কৃষক লিটন চন্দ্র বলেন, কোম্পানির লোক জমিতে দাঁড়িয়ে থেকে তামাক চাষের করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে থাকে। কখনো কখনো অগ্রীম টাকা দিয়ে তামাকের জমি তারা ক্রয় করে। উত্তর হাজিপুর বায়ানপাড়া গ্রামের তামাক চাষি অবিনাশ চন্দ্র বলেন, তামাকের ফলন ভালো হয়েছে দামও ভালো পাব। বায়ানপাড়া গ্রামের কৃষক রতন চন্দ্র বলেন, হামরা গরিব মানুষ লাভ ক্ষতি বুঝি না বাহে। নিজের তেমন জাগাজমি নাই। মাইনসের কাছ থাকি বর্গা নিয়্যা তামাক চাষ করা হয়েছে। তামাক তুলি ওই জমিত ফির ধান চাষ করবো।

উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জামিনুর ইসলাম সাদ্দাম বলেন, তারাগঞ্জ উপজেলার মধ্যে হাজীপুর এলাকায় তামাকের চাষ বেশি হয়। কৃষকেরা অন্যান্য ফসল চাষের জন্য সরকারি সুযোগ সুবিধা পায়। তামাকে বেশি লাভের সম্ভাবনা থাকায় তারা তামাকে আগ্রহী। কৃষি বিভাগ সুত্রে জানা যায়, রংপুর অঞ্চলে তামাকের যে আগ্রাসন সেটি কমাতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেও সফলতা খুব একটা আসেনি। সচেতনতার অভাব এবং বেশি লাভের আশায় কৃষকেরা তামাক চাষে ঝুঁকে পড়ছে।

অথচ গবেষণায় দেখা যায়, তামাকজনিত রোগে প্রতি বছর দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। তারপরও কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না তামাকের আগ্রাসন। রংপুর কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, চলতি বছর রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় তামাক চাষ হয়েছে ১৩ হাজার ৯৪৯ হেক্টর জমিতে। গত বছর চাষ হয়েছিল ১০ হাজার ৮২০ হেক্টর জমিতে। চলতি মৌসুমে শুধু রংপুর জেলায় ১ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। এরমধ্যে রংপুর মেট্রোপলিটন এলাকায় ১০ হেক্টর, রংপুর সদর উপজেলায় ৩৪৫ হেক্টর, গংগাচড়ায় ৫১০ হেক্টর, বদরগঞ্জে ১৫ হেক্টর, তারাগঞ্জ ৯৬০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। রংপুরের আট উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি তামাকের চাষ হয়ে থাকে তারাগঞ্জে। গত বছরের তুলনায় এবারে তারাগঞ্জে ৬০ হেক্টও জমিতে তামাক চাষ বেড়েছে।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, সচেতনতার অভাবে মানুষ তামাক চাষ করছে। লাভ বেশি হলেও তামাক চাষে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে এবং পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। সরকার কৃষি খাতকে সমৃদ্ধ করতে বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করছে। তবে তামাক নিরুৎসাহিত ফসল। এদিকে তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক। তিস্তার বিস্তীর্ণ চরে পরীক্ষামূলকভাবে তামাকের পরিবর্তে গম ও ভুট্টা চাষ বাড়াতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে করে কৃষকরা যেমন কয়েকগুণ বেশি লাভবান হবেন। তেমনি তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে পরিবেশ।

পল্লী উন্নয়ন একাডেমি বগুড়ার অতিরিক্ত মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, দেশের কৃষি জমির পরিমাণ যেভাবে কমে আসছে তাতে আমরা শঙ্কিত। সেই সঙ্গে তামাক চাষের কারণে কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট হওয়াসহ বাড়ছে কৃষকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি। আমরা কৃষকদের তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করতে এবার গম ও ভুট্টা চাষে উৎসাহ দিচ্ছি। তিস্তার চরে ৪শত কৃষককে সার, বীজ, সেচ সুবিধাসহ প্রশিক্ষণ ও কৃষিঋণ দেয়া হয়েছে। একশত একর জমিতে তামাক বাদ দিয়ে গম ও ভুট্টা চাষ করা হয়েছে।