কৃষক মাথায় ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদন করে আর হাত ঘুরলে মূল্য বাড়ে

প্রকাশিত: ৭:০৬ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৬, ২০২৪

বর্তমান খবর,রংপুর ব্যুরো: উত্তরাঞ্চলের অন্যতম পাইকারি মোকাম রংপুর নগরীর সিটি বাজারে বিভিন্ন ধরনের সবজির দাম অনেক কমলেও সাধারণ ভোক্তারা এর সুফল পাচ্ছেন না। প্রান্তিক পর্যায়ে একটি ফুলকপি ও বাঁধাকপি বিক্রয় হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫ টাকা দরে। সেটি তিন হাত ঘুরে খুচরা বাজারে বিক্রয় হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা দরে। ১০ টাকা কেজির টমেটো ভোক্তাদের ক্রয় করতে হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি দরে।

এ ছাড়াও বেগুন, কাঁচা মরিচ, আলুসহ অন্যান্য সবজির দাম কমে গেলেও ভোক্তারা এর সুবিধা পাচ্ছেন না। বরং তাদের ৩-৪ গুণ দামে ভরা মৌসুমেও সবজি ক্রয় করতে হচ্ছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কোনও কার্যকর ভ‚মিকাই পালন করছে না বলে অভিযোগ সাধারণ ভোক্তাদের। বাজারে কৃষক, আড়তদার, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো নানান তথ্য। সবজি বাজার কয়েকজন সিন্ডিকেট চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। তারা বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ইচ্ছেমতো মূল্য বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, রংপুরে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপাদিত হয়। রংপুর দেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ আলু উৎপাদনকারী জেলা। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি প্রচুর পরিমাণে চাষ হয়। যা জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের অনেক জায়গায় চলে যায়। এজন্য রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বলদীপুকুর, দমদমাবাজার, শঠিবাড়ি, রংপুর সদরের পালিচড়াসহ অন্তত ১০টি স্থানে সব ধরনের সবজির পাইকারি বাজার বসে। এখান থেকে ট্রাকে করে রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যাওয়া হয়।

সবজির পাইকারি বাজার বলদীপুকুর ও শঠিবাড়িতে ঘুরে দেখা যায়, ফুলকপি ও বাঁধাকপি প্রতি পিস (এক কেজির ওপরে) ৪-৫ টাকা, টমেটো ১০ টাকা, মোটা বেগুন ৩০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৪০-৪৫ টাকা, আলু ২০ টাকা, শসা ২০ টাকা, করোলা ৪০ টাকা, মুলা ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রয় করছেন প্রান্তিক পর্যায়ের সবজি চাষিরা। কয়েকজন সবজি চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফুলকপি ও বাঁধাকপির মৌসুম শেষ। সে কারণে দাম একেবারে কমে গেছে। চাহিদা আর আগের মতো নেই। ফলে তারা তাদের ক্ষেতে থাকা ফুলকপি আর বাঁধাকপি তুলে ফেলছেন। পাইকারদের কাছে চাহিদা না থাকায় ৪-৫ টাকায় একটি করে বিক্রয় করছেন তারা। মৌসুম শেষের কারণে অন্যান্য সবজি বিশেষ করে কাঁচা মরিচ, পটল, শসা, শিমসহ অন্যান্য সবজি চাষ করছে।

তারা বলেন, প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাই না। বছরব্যাপী ঘাম ঝরানো চাষ করা সবজি আড়তদার, পাইকাররা ক্রয় করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছেন। রংপুরের সিটি বাজারে আড়তদার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার উত্তরাঞ্চলের রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাট জেলার তিস্তা নদীর চরাঞ্চলে ব্যাপক পেঁয়াজ চাষ হয়েছে। কাঁচা মরিচসহ অন্যান্য সবজিও চাষ করা হচ্ছে।

এছাড়াও দেশের মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, বগুড়ায় ব্যাপক হারে পেঁয়াজের চাষ হয়েছে। চাহিদা মিটিয়ে এবার অন্য জেলাতেও যাচ্ছে পেঁয়াজ। তাছাড়া দেশি পেঁয়াজের ঝাঁজ ভারতীয় পেঁয়াজের চেয়ে বেশি। মানের দিক থেকে দেশি পেঁয়াজ অনেক ভালো। এখন আড়তগুলোতে পেঁয়াজ কেজি প্রতি ৮০ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে। প্রান্তিক পর্যায়ে ৬০ টাকা কেজি। তবে খুচরা বাজারে এখনও ৯০ টাকা দরে পেঁয়াজ বিক্রয় হচ্ছে। ভারতীয় পেঁয়াজের চাহিদা একেবারে নেই। ফলে আমদানি করার প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন আড়তদার ব্যবসায়ীরা। প্রান্তিক পর্যায়ে সবজির বাজার থেকে ৫ টাকা দিয়ে প্রতিটি ফুলকপি আর বাঁধাকপি ক্রয় করে নিয়ে যান আড়তদাররা। তারা প্রতিটি কপিতে ৮-১০ টাকা মুনাফা করে বিক্রয় করেন পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা কেজিতে ৫-৭ টাকা মুনাফা করে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রয় করেন। এরপর খুচরা ব্যবসায়ীরা সেই সবজি ৩০ থেকে ৪০ টাকায় ভোক্তাদের কাছে বিক্রয় করছেন। ফলে সবজির দাম কমলেও এর কোনও সুফল পান না সাধারণ ভোক্তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আড়তের কর্মচারী বলেন, সিন্ডিকেটটা করছে আড়তদাররা। তারা পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ভোক্তাদের জিম্মি করছেন। এবার ভরা মৌসুমে সবজি বিক্রয় করে রংপুর সিটি বাজারের চার সিন্ডিকেট আড়তদার কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শরিফুল নামে এক আড়তদার বলেন, তারা ১ টাকা কেজিতে মুনাফা করে সবজি পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রয় করেন। রংপুর সিটি বাজারের পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী শাহ আলম বলেন, কাঁচা মরিচ আমরা ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রয় করছি। ক্রয় করা হয়েছে ৫৫ টাকা কেজি দরে। টমেটো ২৫ টাকা, আলু ২৮ টাকা দরে বিক্রয় করা। একইভাবে পেঁয়াজ ৮০ টাকা দরে ক্রয় করে ৯০ টাকায় বিক্রয় হয়।

২০ গজ দূরে সিটি কাঁচা বাজারে প্রতিটি সবজির দাম আড়তদার, পাইকারদের থেকে অনেক বেশি। তারা তিন-চার গুণ বেশি দরে বিক্রয় করছে। সবজির বাজারে আড়তদার, পাইকার, খুচরা বিক্রেতা কোথাও মূল্যতালিকা টানানো নেই। কত দামে ক্রয় ও বিক্রয় তা উল্লেখ করা হলে ভোক্তারা কিছুটা লাভবান হতেন। এসব নিয়ে প্রশাসন ও ভোক্তা অধিদপ্তর কোনও মাথাব্যথা নেই।

রংপুর সিটি বাজারে সবজি ক্রয় আসা ব্যাংক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাদের বেতন বাড়েনি প্রতিনিয়ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। ফলে কুলাতে পারছি না। বাধ্য হয়ে কম পণ্য ক্রয় করে খেতে হচ্ছে। তারপরেও ধারদেনা করতে হচ্ছে। নির্মাণ শ্রমিক মমতাজ বলেন, ৫০০ টাকা মজুরি পাই। প্রতিদিন তরকারি ক্রয় করতেই ২০০ টাকা চলে যায়। তারপর চালসহ আরও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করতে হয়। কীভাবে চলছি তা নিয়ে কেউই ভাবে না।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রংপুরের প্রধান সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজার রহমান বলেন, তারা সার্বক্ষণিক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজার মনিটারিং করেন। অভিযান পরিচালনা করছেন। ভোক্তাদের স্বার্থে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে কারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।