রংপুর পাসপোর্ট অফিসে ভোগান্তি কমলেও বাতির নিচে অন্ধকার

প্রকাশিত: ৭:৫৬ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৪

বর্তমান খবর,রংপুর ব্যুরো: পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন মানুষের আনাগোনা থাকে। কেউ আসেন পাসপোর্ট করতে আর কেউবা আসেন পাসপোর্ট নেওয়ার জন্য। তবে এ আসা-যাওয়ার মধ্যে হঠাৎ করে নতুন কাউকে দেখলে তার আশপাশ ঘিরে বাড়ে আগন্তুক ব্যক্তির নজরদারি। একপর্যায়ে জিজ্ঞেস করেন আপনি কি পাসপোর্ট করতে এসেছেন? উত্তর যদি আগন্তুক ব্যক্তির আশানুরূপ হয়, তো একপ্রকার তথ্য সহায়তার নামে সেবাপ্রত্যাশী ব্যক্তি পড়বে একটি চক্রের খপ্পরে। এরপর কথাবার্তার মারপ্যাঁচে কেউ চক্রের জালে আটকা পড়ে পাসপোর্ট করেন আর কেউবা পরিস্থিতি বুঝে কেটে পড়েন।

এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে রংপুর বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে। রংপুর বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে ভুক্তভোগীরা বলেন, কেউ কেউ সহজেই পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন। আবার কেউ কেউ সংশোধনের আবেদন করে ঘুরছেন মাসের পর মাস। দালাল চক্রের ব্যবসার ধরন পরিবর্তন হওয়ায় এখন সেখানে বদলেছে সেবার ধরনও। তবে অনলাইনে সব ধরনের সেবাগ্রহণ প্রক্রিয়ার সহজীকরণের ফলে আগের চেয়ে ভোগান্তি, উৎকোচ প্রদানের হার ও বিড়ম্বনা কিছুটা কমে এসেছে বলে অনেকেই জানিয়েছেন। এমন অবস্থা দেখে মনে হয় যেন বাতির নিচে অন্ধকার।

দালাল চক্রের সদস্যরা সাধারণ মানুষদের ক¤িপউটারের দোকান থেকে পাসপোর্ট করতে বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। বিনিময়ে চুক্তি অনুযায়ী ক¤িপউটারের দোকানগুলো থেকে বকশিশ বা মাসোহারা পেয়ে থাকেন। পাসপোর্ট অফিস থেকে বের হলেই চোখে পড়বে আইটি ওয়ার্ল্ড ট্রিটমেন্ট ট্যুর এ্যান্ড ট্রাভেলস নামের একটি দোকান। সেখান থেকে নতুন পাসপোর্ট করার আবেদন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পাসপোর্ট সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য মিলবে।

ওই প্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারী বলেন, অনলাইনে আবেদনের ক্ষেত্রে ৪৮ পৃষ্ঠার এবং পাঁচ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৪ হাজার ২৫ টাকা (বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আবেদনের ক্ষেত্রে ১৫% ভ্যাটসহ) ফি জমা দিতে হবে। এই পাসপোর্ট পেতে ১৫ থেকে ২১ দিন অপেক্ষা করতে হবে। আর জরুরি পাসপোর্ট করতে লাগবে ৬ হাজার ৩২৫ টাকা, আর এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৭ থেকে ১০ দিন।

অন্যদিকে ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে অতীব জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এ ছাড়া ৪৮ পৃষ্ঠার এবং দশ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৫ হাজার ৭৫০ টাকা লাগবে। এই পাসপোর্ট পেতে অপেক্ষা করতে হবে ১৫ থেকে ২১ দিন। আর ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে ফি দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এর বাইরে অতীব জরুরি পাসপোর্ট ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে নিতে চাইলে শুধু ফি গুনতে হবে ১০ হাজার ৩৫০ টাকা।

সরকারি চাকরিজীবী যাদের এনওসি, অবসর সনদ (পিআরএল) রয়েছে তারা নিয়মিত ফি জমা দেওয়া সাপেক্ষে জরুরি সুবিধা/জরুরি ফি জমা দেওয়া সাপেক্ষে অতীব জরুরি সুবিধা পাবেন। পাসপোর্ট নবায়নের ক্ষেত্রে সমপরিমাণ ব্যাংক চালান প্রযোজ্য। নির্ধারিত ফি ছাড়াও অনলাইন ফি বাবদ ৩০০ টাকা এবং পাসপোর্টের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করতে দোকানগুলো অতিরিক্ত আরও ১ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। আবার কেউ কেউ না বুঝে চক্রের ফাঁদে পড়ে এর চেয়েও বেশি টাকা দিয়ে থাকেন। অভিযোগের সুরে এমনটাই জানিয়েছেন জোনাব আলী নামে এক ভুক্তভোগী।

পাসপোর্ট করতে আসা মিঠাপুকুরের জোনাব আলী বলেন, চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি ১০ বছর মেয়াদের ৪৮ পৃষ্ঠার নিয়মিত পাসপোর্টের জন্য ৫ হাজার ৭৫০ টাকা দিয়ে অনলাইনে আবেদন করেন। নির্ধারিত ফি ছাড়াও অনলাইনে আবেদন, পুলিশকে ভেরিফিকেশন ও কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে প্রায় তিন হাজার টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে। ১ ফেব্রæয়ারি পাসপোর্ট দেওয়ার তারিখ থাকলেও ওই দিন থেকে পরপর দুইবার এসে ফেরত যান তিনি। শুধু ক¤িপউটারের দোকান বা অনলাইন সার্ভিস নেওয়ার ক্ষেত্রেই বাড়তি টাকা গুনতে হয় না। টাকা দিলে পাসপোর্ট পেতে ভোগান্তি কমবে এমন আশ্বাস দিয়ে কাজ করে দেন সেখানে দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যরাও।

গাইবান্ধা জেলার বাসিন্দা হলেও বসবাস সূত্রে রংপুর থেকে পাসপোর্ট করতে কি করতে হবে, এ তথ্য জানতে কথা হয় এক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় জানতে না পারায় প্যাকেজ সিস্টেমে পাসপোর্ট করার পরামর্শ দিয়ে ফাহাদ নামে এক পুলিশ সদস্য বলেন, নিজ জেলায় গিয়ে পাসপোর্ট করা ভালো। তবে চাইলে রংপুরেও করা যাবে। তার মাধ্যমে করলে ২ হাজার ৫০০ টাকা বেশি দিতে হবে। সব খরচ মিলিয়ে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা লাগবে। শুধু ওই পুলিশ সদস্যই নয় টাকা দিলে এমন কাজ পাসপোর্ট অফিসের আনসার সদস্যরাও করে দেন। তবে এ ক্ষেত্রে সহজ-সরল ও গ্রাম থেকে আসা মানুষ তাদের টার্গেটের শিকার হয়ে থাকেন।

এমন ঘটনার কথা বলেন, বদরগঞ্জের আনোয়ারা বেগম। সত্তরোর্ধ্ব বয়সী ওই বৃদ্ধা বলেন, ওমরা হজ্ব করার জন্য তিনি পাসপোর্ট করতে রংপুর এসেছেন। এবার নিজের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আসায় ছবি তোলাসহ অন্যান্য কাজে তার কোনো ভোগান্তি হয়নি। এর আগে গত বছর তিনি একাই এসে পাসপোর্ট অফিসের এক দালালের খপ্পরে পড়েছিলেন।

জানা যায়,পাসপোর্ট অফিসের সঙ্গে যুক্ত দালাল চক্রের সদস্যদের একটি অংশ শহরের বিভিন্ন অফিস-আদালতে ঘোরাঘুরি করেন। বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশনের সামনে ও কাচারিবাজার এলাকায় এদের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। কেউ পাসপোর্ট করবেন জানতে পারলে তাদেরকে নানাভাবে ফুসলিয়ে পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।

পাসপোর্ট অফিসের পাশে রাজিয়া আক্তার নামে এক নারী বলেন, দুই সন্তানের পাসপোর্ট এর জন্য বেশ কয়েকবার সংশোধনের আবেদন করেও অজ্ঞাত কারণে কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে সাড়া না দিয়ে হয়রানি করছেন। রংপুর নগরীতে বসবাস করেন এমন পরিচয় দিয়ে ওই নারী বলেণ, স্বামী সৌদি প্রবাসী। তিনি ২০১৮ সালে দুই সন্তানসহ নিজের পাসপোর্ট করেন। পরবর্তীতে স্বামীর নাম সংশোধনীর জন্য আবার নতুন করে ওই বছরেরই ফেব্রæয়ারি মাসে তিনটি পাসপোর্টের জন্য কাগজপত্র জমা দেন। পরে তিনি শুধু নিজের পাসপোর্ট হাতে পান, যা সংশোধিত ছিল। কিন্তু তার দুই সন্তানের পাসপোর্ট না দিয়ে একটি ¯িøপ তাকে ধরিয়ে দেয় পাসপোর্ট অফিস।

রাজিয়া আক্তার বলেন, ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমি যতবার পাসপোর্ট অফিসে এসেছি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউই আমার মূল সমস্যা কী, তা কখনো বলেনি। শুধু আজ হবে না, কাল আসুন নয়ত পরে দেখা করুন, এসব কথা বলে বলে সময়ক্ষেপণ করে আসছেন। দীর্ঘ পাঁচ বছরে আমি রেমিট্যান্স-যোদ্ধা স্বামীর সন্তানদের সংশোধিত পাসপোর্ট হাতে পেতে মাসের পর মাস পাসপোর্ট অফিসে আসা-যাওয়া করছি।

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ পৌর এলাকার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত শাহানা বেগম বলেন, পাসপোর্ট অফিসে এসে নোটিশ বোর্ডে লাগানো নমুনা কপি দেখে নিজেই ফরম পূরণ করে জমা দিয়েছি। নির্ধারিত ফি ছাড়া অতিরিক্ত কোনো টাকা লাগেনি। দালালের খপ্পরে না পড়ে একটু সচেতন হলেই ভোগান্তি ও হয়রানি ছাড়াই পাসপোর্ট পাওয়া যাবে। আগের চেয়ে দালালের উপদ্রব কমেছে দাবি করে রংপুর মহানগরীর সাংস্কৃতিক সংগঠক আরিফুল হক বলেন, মাস দু-এক আগে আমি নিজেই ই-পাসপোর্ট করেছি। শান্ত চিত্তে সেবা গ্রহণ করা যায়। সেবাগ্রহীতাদের জন্য রয়েছে বসার সু-ব্যবস্থা। আগের মতো দালালের দৌরাতœ্য নেই, নেই ভোগান্তি-হয়রানি। তবে একসময় পাসপোর্ট অফিসে দালালের উপদ্রব নিয়ে অনেক সমালোচনা ছিল। সেটা এখন কিছুটা হলেও কমে এসেছে।

রংপুর বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের উপ-পরিচালক শাহ মুহম্মদ ওয়ালিউল্লাহ বলেন, রংপুরে যোগদান করার পর পাসপোর্ট অফিসে দালালের উপদ্রব ও হয়রানি রোধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। আমি কয়েক দিন আগে যোগদান করেছি। এখন পর্যন্ত আমার পাসপোর্ট অফিসে দালালের উপদ্রব চোখে পড়েনি। অফিসের বাইরে যদি দালাল থাকে সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা যাতে কেউ নিতে না পারে সেজন্য অফিসের সকলকে সতর্ক করা হয়েছে।
কোনোরকম হয়রানি ছাড়াই দ্রæত সময়ে জনসাধারণকে পাসপোর্ট সেবা প্রদানের লক্ষ্যে নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন,প্রতিদিন ১০০-১২০টা পর্যন্ত আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে অনেকের ত্রæটিপূর্ণ আবেদনও থাকে, যেগুলো পরবর্তীতে সংশোধন করতে হয়। কারও কোনো অভিযোগ থাকলে সেসব শোনা হয় এবং সমাধানের মতো হলে সেটি করে দেওয়ার চেষ্টা করছি। শাহ মুহম্মদ ওয়ালিউল্লাহ বলেন, অন্যান্য বিভাগীয় শহরের তুলনায় রংপুরে পাসপোর্ট খুবই কম হয়। এখানে যারা সেবাগ্রহীতা তারা ওয়ান-টু-ওয়ান সার্ভিস নিতে পারেন। কোনো চাপ নেই, ঝামেলা নেই। কারও কোনো অভিযোগ থাকলে সেটিও সঙ্গে সঙ্গে শোনা হচ্ছে। আমার স্টাফদের বলেছি একটি ফরমও যদি রিজেক্ট করা হয়, সেটির কারণ যেন আমাকে অবগত করা হয়। পাসপোর্ট প্রত্যাশীর কাজ হলো আবেদন জমা করা। যদি কেউ দালালের কাছে যায় সেটার দায় দায়িত্ব তো আমাদের নয়।

এক রেমিট্যান্স-যোদ্ধার পরিবারের হয়রানির অভিযোগ প্রসঙ্গে ওই কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। কী কারণে তাকে পাঁচ বছর ধরে বারবার আবেদন করে ঘুরতে হচ্ছে, সেটা আগে জানতে হবে। এরপর করণীয় কী সেটা বলা সম্ভব হবে। তবে আমার কাছে গত দুই-তিনে এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে কেউ আসেনি। দালালদের খপ্পরে না পড়ে সরাসরি অফিস নির্দেশনা অনুযায়ী পাসপোর্টের কাগজপত্র জমা দিতে সকলের প্রতি আহŸান জানান তিনি। পাসপোর্ট করতে অতিরিক্ত কোনো টাকা লাগে না এমন নির্দেশনা সাঁটানো রয়েছে। সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে।