বর্তমান খবর,বিশেষ প্রতিবেদন : পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালি সামনের কাতারে ছিল। স্বকীয়তা ধারণ করেই ছিল বাঙালির পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ঐতিহাসিক উক্তি– ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারা ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ এঁকে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে বা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে তা ঢাকবার জো নেই। হিন্দু-মুসলমান মিলিত বাঙালি জাতি গড়িয়া তুলিতে বহু অন্তরায় আছে, কিন্তু তাহা যে করিতেই হইবে’– সেই প্রমাণই দেয়। ভাষা ও জাতীয়তা প্রশ্নে এর চেয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ কী হতে পারে?
এমন বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তান সৃষ্টিলগ্নেই এ অঞ্চলের স্বাধিকারের প্রসঙ্গটি স্পষ্ট উচ্চারণ করেছিলেন। এমনকি ভাষার প্রসঙ্গটি তো পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির জন্ম হওয়ার আগে থেকেই বাঙালি উচ্চারণ করেছিল। উচ্চারিত হয়েছিল পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। এরপর পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে বাংলার কবি, লেখক, শিক্ষক, শিল্পী, আইনজীবীর মতো বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণি স্বাধীনতা আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছেন, নিজেদের অঙ্গন থেকে।
সেই বুদ্ধিবৃত্তি চর্চাকারী পেশাজীবীদের পাকিস্তানিরা শত্রু মনে করবে, এটিই স্বাভাবিক। সুতরাং ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের আগে-পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেভাবে বুদ্ধিজীবীদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, তা ওদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে শুধু এ কারণেই কি তারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে?
মনে করা প্রয়োজন, বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় মূল ভূমিকা পালন করেছে তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত আলবদর বাহিনী। আলবদররা ছিল বাঙালি। তারা নিশ্চিত হয়ে যায়, পাকিস্তান যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে। সুতরাং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ যেন ওদের অসভ্যতা এবং উগ্রতাকে টুঁটি চেপে ধরতে না পারে সেই ব্যবস্থা করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। এর জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল দেশটাকে মেধাশূন্য করে দেওয়া। স্বীকৃত সত্য হচ্ছে, পাকিস্তানি বাহিনীর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে বাঙালি আলবদররা। দুইয়ের লক্ষ্য পূরণই ছিল এই হত্যাকাণ্ডের মূলে। ওরা যে বিশ্বাস নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, সেই বিশ্বাস কিন্তু অস্পষ্ট ছিল না। যেমন– যুদ্ধ চলাকালে কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশে ওরা বাধ্য করেছিল এবং তখনকার সাংবাদিকদের প্রায় শতভাগ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। কিন্তু সংবাদ পরিবেশনায় কলমের পরিবর্তে বেয়নেট কাজ করেছিল। তাই শব্দের মারপ্যাঁচ করতেও দেখা গেছে তৎকালীন পত্রিকাগুলো পরিবেশিত সংবাদে, যা ওই হানাদারদের বিরুদ্ধেই গেছে। সাংবাদিকদের হত্যা করার পেছনে এটিও একটি কারণ ছিল বললে ভুল হবে না।
হানাদাররা বুঝতে পেরেছিল স্বাধীন দেশে ইয়াহিয়া, রাও ফরমান আলী, টিক্কার ঘটনাপ্রবাহ সাংবাদিকরা প্রকাশ করবেন প্রত্যক্ষ সাক্ষীর দৃষ্টিভঙ্গিতে। সত্যি সত্যিই স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সাংবাদিকরা বাংলাদেশের কথাই বলেছেন। তারা নৃশংসতার কথা বলেছেন, বাঙালির ত্যাগের কথা বলেছেন। একই সঙ্গে ইয়াহিয়া বাহিনীর বর্বরতার কথাও প্রকাশ করেছেন।
আমাদের এই সূর্যসন্তানদের যারা হত্যা করেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। কিন্তু চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হওয়ার পরও বিদেশে বহাল তবিয়তে আছে। বঙ্গবন্ধুর কয়েকজন খুনি যেমন বিদেশে পালিয়ে বেঁচে গেছে, তেমনি খুনি আলবদররাও বিদেশে বহাল তবিয়তে আছে। বাংলাদেশ সরকার ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করেও কিনারা করতে পারেনি।
তবে ওদের আনার সর্বোচ্চ চেষ্টার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে অবস্থানকারী বাঙালিরা যদি দর্শনীয়ভাবে দাবিদাওয়া, প্রতিবাদ ইত্যাদি চালু রাখে তাহলে অন্তত খুনিরা মানসিক শাস্তি হলেও পাবে। বিশ্ববাসীও জানতে পারবে খুনিরা আশ্রয় নিয়েছে ওইসব দেশে।
বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য এই পর্যন্ত ব্যাপক প্রচার পেয়েছে আলবদরদের নাম। ওরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু এর পেছনে পরিকল্পনা ও নির্দেশনার কাজটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর। রাও ফরমান আলীর চিরকুট অবশ্যই বড় প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। যদিও রাও ফরমান আলী পরবর্তীকালে নিজের সাফাই গাইতে গিয়ে ওই চিরকুটে কাউকে হত্যার নির্দেশনা ছিল না বলে দাবি করেছেন। তিনি আবার এটি স্বীকার করেছেন তালিকাভুক্ত নামের ব্যক্তিরা পাকিস্তানের সংহতিবিরোধী ছিল। তাদের নাম বাংলাদেশের মানুষ তথা এই আলবদররা তাঁকে জানিয়েছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, রাও ফরমান আলীর চিরকুটে উল্লেখ করা বুদ্ধিজীবীদেরই হত্যা করা হয়েছে। সুতরাং স্পষ্ট হয়ে যায় আলবদর বাহিনী তাদের হত্যা করলেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত (দ্রষ্টব্য– পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে একাত্তর, সম্পাদনা– মুনতাসীর মামুন ও মহিউদ্দিন আহমেদ, ইউনিভার্সিটি প্রেস লি.)।
আজকে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করার দাবি সংগত কারণেই আসতে পারে। পাকিস্তানি বাহিনীর যেসব সদস্য এই বর্বরোচিত কাজের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিষয়ে আরও তদন্ত হওয়া দরকার।
অন্যদিকে আলবদর বাহিনীর যেসব সদস্য এখনও বেঁচে আছে, তাদের বিষয়েও তদন্ত করে নাম প্রকাশ করা উচিত। শুধু তাই নয়, যারা আলবদর বাহিনীর আদর্শিক অনুসারী তাদেরও আলবদর হিসেবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
সব বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার না হলে যতই বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হোক তাদের আত্মা শান্তি পাবে না। আমরাও হতে পারব না দায়মুক্ত।
লেখক: মোস্তফা হোসেইন: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক