এই যুগোত কি ২০০ টাকা মজুরি দিয়া জীবন বাঁচা যায়? – হাসিনা বেগম

প্রকাশিত: ৪:৪১ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৮, ২০২৪

বর্তমান খবর,রংপুর ব্যুরো: মাছ-মাংস ও সয়াবিন তেল কেনা করা তো দুরের কথা ভর্তা খাবার জন্য আলু কিনতে করতে পারছি না। এক সের আলু ৮০ টাকা, এক সের চাল ৫৫ টাকা। তেল-মসলা,সাবান-কাপড় তো আছে। সারা দিনে কাজ করি মজুরি পাই ২০০ টাকা। এই যুগোত কি ২০০ টাকা মজুরি দিয়া জীবন বাঁচা যায় কন?

৮ ডিসেম্বর রবিবার রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী মাঠে আলু লাগানোর সময় আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন নারী শ্রমিক হাসিনা বেগম। শ্রমিক হাসিনা বেগমের বাড়ি জুম্মাপাড়া গ্রামে। ১৫ বছর আগে দিনমজুর স্বামী মারা গেলে সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। ৫০ টাকায় দিনমজুরি শুরু করেন তিনি। দেড় দশকে সেই মজুরি ২০০ টাকা হলেও চার সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।

হাসিনা বেগম আক্ষেপ করে বলেন,সকাল ৮টায় মাঠে আসি, বিকাল ৫টায় কাজ শেষ করি বাড়ি যাই। পুরুষেরাও একই সঙ্গে কাজ শেষ করি ঘরে ফেরেন। কিন্তু পুরুষেরা ৬০০ টাকা মজুরি পায়। আমরা পাই মাত্র ২০০ টাকা। যে ভাবে তরি-তরকারি,চাল-ডাল-তেলের দাম বাড়ছে,এই টাকায় একবেলার খাবার হয় না। আমাদের মতো নারীরা যেন ন্যায্য মজুরি পায় সবার কাছে আকুল আবেদন আমার।

হাসিনা বেগমের পাশে কাজ করা প্রামাণিকপাড়া গ্রামের বুলবুলি বেগম বলেন, আলু লাগানো থেকে তোলা পর্যন্ত নারী শ্রমিকের কোনো বিকল্প নেই। রোদে পুড়ে দিনভর কাজ করেও আমরা ন্যায্য দাম পাই না। আমাদের ৪০০ টাকা মজুরি করা হলে সংসার কোন মতে চলতো। তাহলে আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে ভালোভাবে দুই বেলা খেয়ে বাঁচতে পারব। শুধু হাসিনা ও বুলবুলি নয় তাদের মতো মজুরি নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে রংপুরের হাজারো নারী শ্রমিকের।
শুধু কৃষি ক্ষেত্রেই নয় দিনমজুরি করতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নারীরা।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়,চলতি মৌসুমে রংপুর, কুড়িগ্রাম,লালমনিরহাট, নীলফামারী,গাইবান্ধা জেলায় আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লক্ষ এক হাজার ৫৭৬ হেক্টর জমি। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৬ লক্ষ ৯৯ হাজার ১৫৭ মেট্রিক টন। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত আলু রোপণ করা হয়েছে ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে।

আলু চাষি ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক হেক্টর জমিতে আলু রোপণ করতে পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকের প্রয়োজন হয় ৩০ জনের। সে হিসেবে রংপুর অঞ্চলে এবারে আলু রোপণে নারী শ্রমিকের প্রয়োজন ৩০ লক্ষ ৪৭ হাজার ২৮০ জন। একজন পুরুষ মজুরি পাচ্ছে ৬০০ টাকা। আর নারী শ্রমিককে দেওয়া হচ্ছে ২০০ টাকা। সে হিসেবে পুরুষের সমান নারীদের মজুরি হিসেব করলে শুধু আলু রোপণে ১২১ কোটি ৮৯ লক্ষ ১২ হাজার টাকা বঞ্চিত হচ্ছেন নারী শ্রমিকেরা।

রংপুর অঞ্চলে এখন চলছে আলু রোপণের মৌসুম। তিন ফসল রোপণ ও উত্তোলনে নারী শ্রমিকই একমাত্র ভরসা। কিন্তু মজুরির ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। একজন পুরষে সঙ্গে আলু রোপণ,মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া, লাঙল টানার কাজ সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত করলেও পুরুষ শ্রমিকের তিন ভাগের এক ভাগ মজুরি পান নারী শ্রমিকেরা। তারাগঞ্জে দোলাপাড়া মাঠে গিয়ে দেখা যায় কয়েক হেক্টর জমিতে আলু লাগাচ্ছেন কয়েকজন কৃষক। সেখানে পুরুষের পাশাপাশি আলু রোপণে কাজ করছেন শতাধিক নারী শ্রমিক। সেই নারীদের কেউ ফালি টানছেন, কেউ আলুর ফালি বসাচ্ছেন, কেউ আবার সেগুলো মাটি দিয়ে ঢেকে দিচ্ছেন।

মেনানগর গ্রামের নারী মনোয়ারা বেগম বলেন, চার সদস্যের সংসার তাঁর একার আয়ে চলে। গত বছর ১৮০ টাকা কাম করছি, এবার ২০০ টাকা। খালি ২০ টাকা মজুরি বাড়ছে। কিন্তু বাজারোত এই এক বছরে চাল, তেল, সবজির দাম কেজিতে ২০ থাকি ৩০ টাকা বাড়ছে। ২০০ টাকা দিয়া চাল কিনি না, সবজি কিনি বাজারোত গেইলে সেই চিন্তায় মাথা ঘোরে। নারী জন্যে কি হামরা সগটে অবহেলার পাত্র।

নারীদের কম মজুরির বিষয়ে কৃষক জিকরুল হক বলেন, নারীরা ছাড়া আলু রোপণ ও উত্তোলন প্রায় অসম্ভব। এটাও ঠিক যে তাঁরা সকাল ৮ থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত পুরুষের সঙ্গে কাজ করছেন। কিন্তু হুট করে আমি তো মজুরি বাড়াতে পারি না। সবাই যা দেয় আমিও তাই দেই। তবু গত বছরের চেয়ে এবার ২০ টাকা বেশি দেওয়া হচ্ছে।

মানব কল্যাণ ঘর সামাজিক সংগঠনের সাধারণ স¤পাদক জেমিন শেখ বলেন, যে নারীরা মাঠে কাজ করছেন তার অধিকাংশরই পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নেই। কেউ স্বামীহারা, কারও স্বামী কাজ করতে অক্ষম। অভাবের তাড়নায় পরিবারের মুখে দুমুঠো ভাতের জোগান দিতে তাঁরা নিয়মিত মাঠে বিভিন্ন কাজ করেন। কিন্তু তাঁরা ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে না। ঘরে-বাইরে নারীরা যে বৈষম্যের শিকার তা এটা দূর হওয়া দরকার।

তারাগঞ্জের মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নুরেশ কাওসার জাহান বলেন, সরকারি কাজ যেমন টিআর, কাবিখা, কর্মসৃজন প্রকল্পের কাজে নারী-পুরুষ সবাইকে সমান মজুরি দেওয়া হয়। সবারই উচিত নারীদের পুরুষের মতো সমান মজুরি দেওয়া। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে এ ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।