তিস্তা নিজেও মরছে, হামাকও মারছে

প্রকাশিত: ৬:৪৯ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৭, ২০২৪

বর্তমান খবর,রংপুর ব্যুরো: নদীর কি নীলাখেলা। প্রকৃতির মহিমায় নদী এক কুল ভাঙ্গে আর আরেক কুল গড়ে। বর্ষাকালে পানিতে থৈ থৈ করে নদীর উভয় কুল। ভাসিয়ে দেয় মানষের ঘরবাড়ী। তলীয় যায় কৃষকের জমির ফসল। আবার কখনো নদীর পানি কমে যেয়ে পড়ে বালুচর। এই প্রকৃতির নীলাখেলায় তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে বিশাল বালুচর। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চরে হচ্ছে ফসল চাষ। কোথাও বা বিকাল হলেই চলে জমজমাট ফুটবল-ক্রিকেট ম্যাচ। ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার নীতিতে তিস্তা এখন রংপুর,নীলফামারী,লালমনিরহাট,গাইবান্ধার ও কুড়িগ্রাম জেলার নদীর তীরবর্তী এলাকার মানুষের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই অবস্থা বড়াল নদের।

দখল-দূষণে এক সময়ের খরস্রোতা এ নদ সরু নালায় পরিণত হয়েছে। বড়ালকে বাঁচাতে নেওয়া প্রকল্পের প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয় থেকে নবমবারের মতো ফেরত এসেছে। এতে বড়ালের বাঁচার আশা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে মনে করছেন এ নদ রক্ষা আন্দোলনে জড়িতরা।

তিস্তা নিজেও মরছে, হামাকও মারছে। নদীত অ্যালা পানি নাই, মাছও নাই। খ্যায়া-না খ্যায়া দিন কাটে হামার। পানিশূন্য তিস্তাকে দেখিয়ে ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলেন নদীতে মাছ ধরে সংসার চালানো জেলে ক্ষিতিশ চন্দ্র দাস। তিস্তার বুকে এখন জেগে উঠেছে বিশাল চর। কোথাও কোথাও সবজি ফলিয়েছেন স্থানীয়রা। কোথাও বিকাল হলে চরে বসে জমজমাট ফুটবল-ক্রিকেট ম্যাচ। ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করায় তিস্তা এখন বৃহত্তর রংপুরের পাঁচ জেলার মানুষের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় তিস্তা এখন রংপুর অঞ্চলের মানুষের অভিশাপ।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের উত্তরের অন্যতম প্রাণপ্রবাহের উৎস তিস্তার এমন দশায় উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা। ৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ খরস্রোতা তিস্তা নদী সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশের নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা হয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারীর ভেতর দিয়ে ১২৪ কিলোমিটার অতিক্রম করে ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে মিশেছে। সেই চির যৌবনা তিস্তা ক্ষীণ হতে হতে মরে যাচ্ছে। তার বুক জুড়ে খরস্রোতা জলের ধারা আর নেই। তিস্তার বুকে বিস্তীর্ণ চর জেগে উঠায় হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য।

বিশেষ করে দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ থেকে ভাটিতে কুড়িগ্রাম পর্যন্ত নদীর এমন হতশ্রী চেহারা চোখে পড়ে। প্রয়োজনীয় পানি না থাকায় তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে এ অঞ্চলে কৃষিজমিতে যে সেচ দেওয়ার কথা, সেটাও এখন অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কৃষি, মাছ, পরিবেশ ও নৌ যোগাযোগের ক্ষেত্রে। তিস্তা নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে পানির স্তর নি¤œমুখী হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়,শুষ্ক মৌসুমে নদীর স্বাভাবিক গতি ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজে প্রতিদিন পানির প্রয়োজন অন্তত ৭ থেকে ১০ হাজার কিউসেক। সেখানে পানি পাওয়া যায় মাত্র ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ কিউসেক। প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুম ধরা হলেও নভেম্বর থেকেই নদী শুকিয়ে যায়। তিস্তা ব্যারাজের উজানে ভারত ১৯৮৭ সালে গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার শুরু করে। এতে তিস্তা অববাহিকায় নেমে আসে ঘোর অমানিশা। গত ৩৭ বছরে সোয়া দুই কোটি কিউসেক পানি থেকে বঞ্চিত হয়েছে তিস্তাপারের মানুষ। আবার বর্ষা মৌসুমে পানি ছেড়ে দিয়ে নদীর দু’ক‚ল ভাসায় ভারত। এসময় পানির প্রবাহ থাকে প্রায় ১ লক্ষ কিউসেক।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, এখন শুষ্ক মৌসুমে ১ হাজার কিউসেকের মতো পানি পাওয়া যাচ্ছে। যদিও নদীর গতিপথ ঠিক রাখতে ৭ থেকে ১০ হাজার কিউসেক পানির প্রয়োজন। ১ হাজার কিউসেকের কম পানি থাকলে তিস্তা ব্যারাজের সবগুলো গেট বন্ধ করেও সেচ সুবিধা দিতে হিমশিম খেতে হয়। তখন ভাটি এলাকায় নদীতে এক ফোঁটা পানি ছাড়ারও সুযোগ থাকে না। তিস্তা ব্যারাজের পানি নিয়ন্ত্রণে তৈরি ৪৪টি জলকপাট রযেছে।

নদীর ভাটিতে যতদূর চোখ যায়, শুধু বালু আর বালু। মাঝেমধ্যে পানির মৃদু ধারা। পানির অভাবে চলাচল করতে না পারায় বেঁধে রাখা হয়েছে নৌকাগুলো। অনেকে হেঁটেই পার হচ্ছে তিস্তা। পানির অভাবে ব্যারাজের ভাটিতে তিস্তার ছোট-বড় শতাধিক খেয়াঘাট বন্ধসহ নৌ-যোগাযোগের ক্ষেত্রে মারাত্মক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

গঙ্গাচড়ার বিনবিনা চর এলাকার সাইফুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তারা তিস্তার পলি পড়া চরে নানা ফসল ফলাতেন। নদীর পানিতে সেচ সুবিধা থাকায় উৎপাদন খরচ কম হতো। কিন্তু এখন আর সেইদিন নেই, নদী শুকিয়ে মরুভ‚মি হয়েছে। নদীর বুকে সেচযন্ত্র বসিয়ে চাষকৃত ফসলে সেচ দিতে হচ্ছে। গঙ্গাচড়া উপজেলার ল²ীটারি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী বলেন, তিস্তার বেহাল দশায় নানামুখী সমস্যায় পড়েছে নদীপারের মানুষ। নদীতে পানি না থাকায় মৎস্যজীবীরা বেকার হয়ে পড়েছে।

চরাঞ্চলের জমিতে বিভিন্ন ফসলের চাষ করেও পানির অভাবে সেচ দিতে না পারায় কৃষকরা বছরের পর বছর ধরে লোকসান গুনছে। খেয়াঘাটগুলো বন্ধ হওয়ায় বেকায়দায় পড়েছে মাঝি-মাল্লারাও। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গাছপালা মরে যাচ্ছে। নলক‚প কিংবা মাটির কুয়ায় ঠিকমতো পানি উঠছে না। এতে বিশুদ্ধ পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে। চরাঞ্চলগুলো প্রায় মরুভ‚মির রূপ নিচ্ছে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালযের শিক্ষক ও নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, বন্যা-ভাঙনসহ পানিহীন তিস্তার বহু রূপ দেখেছে এ অঞ্চলের কয়েক প্রজন্ম। তিস্তাপারের মানুষের ছুটে চলার পথ শুধু বসতভিটা আর তিস্তায় জেগে ওঠা চরের কৃষিজমি। সে কারণে নিজ দেশীয় ব্যবস্থাপনায় তিস্তা নদীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।