বর্তমান খবর: মুঠোফোন বা মোবাইল ফোন এখন আমাদের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্রাউজিং ও কথা না বলে থাকার কথা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। ব্যবসা, শিক্ষা, চিকিৎসা থেকে ব্যক্তিগত পর্যায় সবখানেই মুঠোফোনের ব্যবহার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কিন্তু গত কয়েক মাসে কোন কারণ ছাড়াই মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো পাল্লা দিয়ে ইন্টারনেট ও টকটাইম প্যাকেজের দাম বাড়িয়ে চলায় গ্রাহকরা মুঠোফোন প্যাকেজের খরচ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
৫ সদস্যের একটি পরিবারে স্বামী, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, বাবা—মা সকলে মিলে কমপক্ষে ৪—৫টি মোবাইল ফোন অপারেট করে। এই মোবাইল ফোনগুলোর ব্যয়ভার নির্বাহ করছেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি। বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, মাছ, মাংস, সবজি, জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি পেলে যেমন তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন মুঠোফোন ব্যবহারের ব্যয় বাড়ায় তিনি একই ভাবে চিন্তিত হয়ে পড়ছেন। ভুলে গেলে চলবে না দেশে সচল প্রায় ১৮ কোটি সিমের সিংহভাগ গ্রাহকই কিন্তু নিম্নবিত্ত। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে রক্ত—ঘামে উপার্জিত প্রতিটি টাকা তাদেরকে অত্যন্ত হিসাব করে ব্যয় করতে হয়।
ঘটনার পোস্টমর্টেম করার আগে আমাদেরকে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। গত বছরের অক্টোবর মাস। হঠাৎ করে তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার উপলব্ধি করলেন মুঠোফোন অপারেটরগুলোর প্যাকেজের সংখ্যা এত বেশি হওয়ায় সাধারণ গ্রাহকরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তাই তিনি হয়রানি কমাতে অপারেটরগুলোকে প্যাকেজ সংখ্যা কমিয়ে আনার নির্দেশ দিলেন। তার এ নির্দেশের পর ১৫ অক্টোবর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এক নির্দেশিকার মাধ্যমে মুঠোফোন অপারেটরগুলোকে ৭ দিন, ৩০ দিন ও আনলিমিটেড মেয়াদি প্যাকেজ দেয়ার নির্দেশ দেয়।
নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী অপারেটরগুলোর ৪০টির বেশি প্যাকেজ দেয়ার এখতিয়ার থাকবে না। এ নির্দেশনার আগে ৩, ৭, ১৫, ৩০ দিন ও আনলিমিটেড মেয়াদি প্যাকেজ ছিল। অপারেটরগুলো তখন ৯৫টি প্যাকেজ দিতে পারত। অপারেটরগুলো প্যাকেজ কমিয়ে আনার সময় নাকি দাম বাড়বে বলে মন্ত্রী মহোদয়কে সতর্ক করেছিল। একই আশঙ্কা টিক্যাবের মতো গ্রাহক সংগঠনগুলোও করেছিল। সকলের যা শঙ্কা ছিল হলো তাই। রাতারাতি প্যাকেজের দাম বাড়ায় দেশব্যাপী সমালোচনা শুরু হলে মন্ত্রী মহোদয় বিরক্ত হয়ে পূর্বে দামে ফিরে যেতে অপারেটরগুলোকে নির্দেশ দেন। কিন্তু মজার বিষয় হলো প্যাকেজ কমাতে তার নির্দেশ বিদ্যুৎবেগে কাজ করলেও দাম কমানোর নির্দেশে কোন কাজ হয়নি। ঠিক যেভাবে আমাদের দেশে কোন পণ্যের দাম একবার বাড়লে সাধারণত আর কমে না। অপারেটরগুলো শুধু প্যাকেজের মেয়াদ ও মূল্য পুনর্নির্ধারণ করে ক্ষান্ত হয়নি, যেখানে আগে ২০ টাকা রিচার্জ করলে ৩০ দিন মেয়াদ পাওয়া যেত সেখানে এখন ৭ দিন মেয়াদ পাওয়া যায়। ৭ দিন পর সিমের আউটগোয়িং বন্ধ করে দেয় অপারেটরগুলো। তাই যেসকল গ্রাহক আগে মাসে ২০ টাকা রিচার্জ করে সিম সচল রাখতে পারতেন তাদেরকে মাসে ৪ বার চার রিচার্জ করতে হচ্ছে অন্যথায় বড় প্যাকেজ নিতে হচ্ছে। এককথায় মানুষকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাড়তি অর্থ খরচে বাধ্য করছে অপারেটরগুলো।
মুঠোফোন অপারেটরগুলো যাতে গ্রাহক স্বার্থের পরিপন্থী কোন পদক্ষেপ নিতে না পারে যে জন্য “বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)” নামে সরকারের একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা রয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি সহ যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিটিআরসি’র গণশুনানীর আয়োজন করার বিধান রয়েছে। অতীতেও আমরা দেখেছি বিভিন্ন বিষয়ে বিটিআরসি গণশুনানীর আয়োজন করেছে। কিন্তু প্যাকেজ কমানো ও মূল্য বাড়ানোর মতো এতটা জনগুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে কেন তারা কোন গণশুনানীর প্রয়োজন মনে করেনি তা আমাদের বোধগম্য নয়। এতে গ্রাহকদের আদৌ উপকার হবে নাকি অপকার হবে তা জানার চেষ্টাও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ করেছে বলে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। যেমন ধরুন, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীকে তার এসাইনমেন্টের জন্য তাৎক্ষনিক ইন্টারনেট ব্যবহার করা প্রয়োজন। তার বাসায় ব্রডব্যান্ডের ওয়াইফাই সংযোগ রয়েছে। তার এখন শুধুমাত্র কয়েক ঘন্টা বা একদিনের জন্য ইন্টারনেট হলেই চলবে। পূর্বে সে অত্যন্ত কম মূল্যে কয়েক ঘন্টার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পেলেও বর্তমানে তাকে উচ্চমূল্যে কমপক্ষে সাত দিনের প্যাকেজ কিনতে হচ্ছে। এতে তার উপকার হল নাকি অপকার হলো বুঝতে আমাদের রকেট সায়েন্স জানার প্রয়োজন নেই।
প্যাকেজ কমানোর পর থেকে অপারেটরগুলো দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে আর মেয়াদের ফাঁদে ফেলে গ্রাহকদের নাভিশ্বাস তুলেছে। কেউ কেউ বলছেন ইন্টারনেট প্যাকেজের দাম বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ, কেউ বলছে ৩০ শতাংশ, কেউ বলছে তারও বেশি। টেলি কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিক্যাব) এর পক্ষ থেকে যে কয়েকজন গ্রাহকের সাথে কথা বলা হয়েছে সবাই এই মূল্যবৃদ্ধিতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা জানিয়েছেন যেখানে আগে ২০০ টাকার একটি প্যাকেজ নিয়ে মাস পার করা যেত যেখানে এখন ৫০০ টাকা লাগছে। যাদের ৫০০ টাকার প্যাকেজে চলতো তাদের এখন ৮০০ টাকার প্যাকেজ নিতে হচ্ছে। খরচ কমাতে অনেকেই ব্যবহার কমিয়ে আনছেন অথবা ব্যবহার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। গত বছরের ডিসেম্বরে দেশে মোবাইল ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ছিলো ১১ কোটি ৮৪ লাখ। নতুন বছরের জানুয়ারিতে সেই সংখ্যা কমে হয় ১১ কোটি ৬৩ লাখ। বর্তমানে গ্রাহক সংখ্যা আরো কমেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। ২০২৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, ভিপিএন সেবাদানকারী প্ল্যাটফর্ম সার্ফ শার্ক প্রকাশিত গ্লোবাল ইন্টারনেট ভ্যালু ইনডেক্স (আইভিআই) শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশিরা ইন্টারনেট ব্যবহারে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় প্রায় ৬ দশমিক ৯ গুণ বেশি অর্থ খরচ করছে বলে দাবি করা হয়। বর্তমানে সে ব্যয় যে দিগুণ হয়েছে তা আর বলার অবকাশ রাখে না। মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ওকলার ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের ‘স্পিডটেস্ট গ্লোবাল ইনডেক্স’ নামের নিরীক্ষায় মোবাইল ইন্টারনেটের গতির দিক দিয়ে ১৪২ দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে ১১১তম অবস্থানে দেখানো হয়েছিল। অর্থাৎ আমাদের দেশের ইন্টারনেটের অবস্থা ‘দামে বেশি মানে কম’।
বর্তমানে গ্রাহকরা অপারেটরগুলো দ্বারা বহুমুখী পন্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একদিকে গ্রাহকদেরকে উচ্চমূল্যে নির্দিষ্ট মেয়াদের প্যাকেজ কিনতে হচ্ছে অপরদিকে মাস শেষে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই প্যাকেজের অব্যবহৃত ডাটা ও টকটাইম ব্যবহারের সুযোগ থাকছে না। কারণ গ্রাহকগুলোর শর্ত হচ্ছে অব্যবহৃত ডাটা ও টকটাইম ব্যবহার করতে হলে এক মাস শেষ হওয়ার পূর্বে সেই একই প্যাকেজটি পুনরায় চালু করতে হবে। কিন্তু টিক্যাবের কাছে অনেক গ্রাহক অভিযোগ করেছেন ‘মাই অফার’ থেকে একটি প্যাকেজ রিচার্জের পরবর্তী মাসে ৩০ দিন মেয়াদের মধ্যে সেই একই প্যাকেজটি আর তাদেরকে দেয়া হয় না। ফলে তারা তাদের অব্যবহৃত ডাটা ও টকটাইম ব্যবহার করতে পারেন না। অপরদিকে অনেক ব্যবহারকারী শত ব্যস্ততার মধ্যে প্যাকেজের মেয়াদ শেষের তারিখ মনে রাখতে না পারায় দেরিতে রিচার্জ করে অব্যবহৃত ডাটা ও টকটাইম ব্যবহারের সুযোগ হারিয়েছেন। এভাবে একটি প্যাকেজের সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের পরও গ্রাহকদের তার পূর্ণ ব্যবহারের সুযোগ না দিয়ে অপারেটরগুলো অব্যবহৃত ডাটা ও টকটাইম একাধিকবার বিক্রি করছে। যা নৈতিকভাবেও সমর্থনযোগ্য নয়। টিক্যাবের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে যেকোন প্যাকেজ নিলেই অব্যবহৃত ডাটা ও টকটাইম ব্যবহার সুযোগ দেয়ার দাবি জানানো হলেও সংশ্লিষ্টরা তাতে কর্ণপাত করেনি।
বর্তমান সরকার অতীতের সরকারগুলোর তুলনায় প্রযুক্তিবান্ধব সরকার হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১ প্রতিষ্ঠা ও উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট বাংলাদেশ রোডম্যাপ প্রস্তুত করা হয়েছে। এ রোডম্যাপের পিলার ৪টি হলো যথাক্রমে— স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট গভন্যর্ান্স। কিন্তু প্যাকেজ মূল্য বাড়িয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারে গ্রাহকদেরকে নিরুৎসাহিত করে আদৌ স্মার্ট সিটিজেন তৈরি করা সম্ভব কি না তা আমাদের জানা নেই। সাধারণ মানুষের কাঁধে বাড়তি ব্যয়ের বোঝা চাপানোর আগে ভেবে দেখা দরকার তারা সেই বোঝা কতটা বইতে সক্ষম। তাই সংশ্লিষ্ট সকল স্টেক হোল্ডারের কাছে মুঠোফোন প্যাকেজের মূল্য কমিয়ে সাধারণ নিম্ন আয়ের গ্রাহকদের একটুখানি স্বস্তি দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
লেখক,
মো. মুর্শিদুল হক
(বিএসসি ইন সিএসই)
আহ্বায়ক
টেলি কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিক্যাব)