বর্তমান খবর : ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনের জন্যে একটি গৌরবময় দিন। এ দিনটিতেই তদানীন্তন ব্রিটিশ-ভারতের গোপালগঞ্জ মহকুমায় আবির্ভাব ঘটেছিল একজন মহামানুষের। গোপালগঞ্জের বাইগার নদীটি খুব বেশি বড় ছিল না। সেই নদীর কূল ঘেঁষে সুজলা-সুফলা শস্যশ্যামলা সাজানো-গোছানো ছবির মতো একটি গ্রাম টুঙ্গিপাড়া। বাইগার নদী মধুমতীতে মিশে যায়। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামটি যেন মহাকালের সাক্ষী হয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে বুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কেননা এ গ্রামটিতেই জন্মেছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাল্য নাম খোকার জন্মের মধ্য দিয়েই এ উপমহাদেশে ঘটেছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ। যিনি ধীরে ধীরে বড় হয়ে রূপান্তরিত হয়েছিলেন ছায়াদানকারী বটবৃক্ষে। সে জন্য এটি জন্ম নয়, আবির্ভাব নির্ঘণ্ট। একটা জাতির রূপকার, একটি দেশের আধার। তিনি এসেছিলেন কর্মকুশলী হয়ে অঘটনঘটনপটীয়সী হিসেবে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এমন মানুষের জন্ম বা আবির্ভাব ঘটে যুগ-যুগান্তর পরে।
আজ আমরা যে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ কিংবা গর্বিত সেটি কেবলই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্যে। শতাব্দীর পর শতাব্দী যে জাতি শোষিত হয়ে আসছিল, বঞ্চিত হয়ে আসছিল পরাধীনতার গ্লানি ভোগ করছিল সেই জাতিকে মুক্তি দিয়ে রাজনৈতিক অধিকার পাইয়ে দিয়েছিলেন। সেই কীর্তিমান মহাপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান। জীবনে যিনি এতটুকু কোনো ভণিতা নয়, একেবারে বাস্তবতার আলোকে উদ্ভাসিত করেছিল একটা জাতিকে। সীমাহীন ত্যাগী পুরুষ ছিলেন আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনের উল্লেখযোগ্য সময়টুকু কাটিয়েছেন জেলখানার চৌহদ্দিতে। আপসকামী হলে, কিংবা ইচ্ছা করলে ভোগবিলাসে মেতে থাকতে পারতেন, কিন্তু তিনি সেটি না করে একটি বঞ্চিত জাতির জন্য লড়াই করেছেন, সংগ্রাম গড়ে তুলেছেন। অধিকার সচেতন করতে ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ছোটবেলা কেমন কেটেছে, কীভাবে তিনি পড়াশোনা করেছেন, কতটুকু মানবিক ছিলেন তা তার জীবনীতে উল্লেখ আছে। তিনি যে সত্যি গবেষণার বস্তু তা প্রতি বছর তার জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রকাশিত লেখা পড়লেই উপলব্ধি করা যায়। আমার দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর জীবনটাই একটা গবেষণাগার। তিনি কালপুরুষ হিসেবে গোটা বাঙালি মানসে দেদীপ্যমান। অন্যদিকে বিশ্ব দরবারে মহত্ত্বের গৌরবে গৌরবান্বিত। মানব জাতি হিসেবে তিনি মনুষত্ব বিকাশে অনন্য অবদান রেখেছেন। একটি জাতির পিতা হিসেবে যেমন বাঙালির গর্বের ধন তেমনি বিশ্ব মানব সমাজে মনুষ্যত্বের অবয়ব। শোষিতের পক্ষে সুস্পষ্ট অবস্থানের কারণেই পরাধীন দেশের মহানায়ক পৃথিবীতে বাঁচতে পারেননি বেশিদিন। কিন্তু জগতের সব মানুষের মানসপটে শেখ মুজিব সমুজ্জ্বল।
ব্রিটিশ-ভারত স্বাধীন হয় ১৯৪৭ সালে। তরুণ শেখ মুজিব বুঝে গিয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলেও স্বাধীন পাকিস্তানের বৃহত্ জনগোষ্ঠী বাঙালি জাতি পরাধীনই থেকে যাবে। তিনি একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ব্রিটিশ রাজের শাসনের পতন ঘটলেও পাকিস্তানের একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ওপর অপশাসন প্রবর্তিত হয়। একটা জাতির প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ হয়। সেই আচরণের বিরুদ্ধে তরুণ শেখ মুজিবই প্রতিবাদী হয়ে উঠেন। পাকিস্তানের উষালগ্ন থেকেই শেখ মুজিব বাঙালি জাতির ন্যায্য অধিকারের জন্য সাংগঠনিকভাবে আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। সেই প্রতিবাদ একদিন মনুষ্যত্ব বিকাশে ভূমিকা রাখে। গণতন্ত্রমনা শেখ মুজিব কখনো প্রতিহিংসার রাজনীতি করতেন না। তার রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরোধিতাকারীদেরও তিনি সম্মান দিয়ে কথা বলতেন, মর্যাদা দিতেন। শুধু অপরাধ অন্যায়কে তিনি সমর্থন করতেন না। এখানেই তার মহত্ত্ব তার বীরত্ব। মূলত তার বীরত্বেই বাঙালির বীরত্বগাথা ইতিহাস তৈরি হয়েছে। তিনি জন্মেছিলেন বলেই একটি সার্বভৌম দেশ ও স্বাধীন জাতি পৃথিবীর মানচিত্রে সুবর্ণ রেখায় দণ্ডায়মান। যে সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি সীমাহীন কষ্ট করেছেন। তার কষ্টের ফল আজ গোটা বাঙালি ভোগ করছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের শাসনকর্তা হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। ঘাতকের বুলেটে তিনি সপরিবারে নিহত হলেও বেঁচে যাওয়া কন্যাদ্বয়ের একাগ্র সাধনায় মুজিব আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঘাতকরা তাকে হত্যা করে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে বিলীন করতে চেয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শ এতটাই শক্তিশালী যে, শত ষড়যন্ত্রেও শেষ করতে পারেনি।
আজ শিশু-কিশোরের কচি হূদয়েও বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি জ্বলজ্বল করে। আর তাই ১৭ মার্চ শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু শিশুদের প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। তার হূদয়ও ছিল শিশুদের মতো কোমল। প্রচণ্ড বিশ্বাসী ও আত্ম-প্রত্যয়ী মহান মানুষটির জীবনাবসান যেভাবেই ঘটুক না কেন, তিনি তার কর্ম ও আদর্শের মধ্যে বেঁচে থাকবেন যতকাল পৃথিবী থাকবে। ফুলের সৌরভে ১৭ মার্চ পালিত হয় অনন্য গৌরবে। স্বপ্ন-সাধের বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। মনুষ্যত্বের বিকাশে বাংলার স্থান হবে সবার শীর্ষে। তার জন্মদিনে এ প্রত্যাশা রেখেই গভীর শ্রদ্ধা জানাই মহান নেতাকে।
**সামছুল আলম দুদু-এমপি
লেখক: রাজনীতিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য