দরকষাকষি ছাড়াই চুক্তি করা হয়েছিল বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে

হাসিনার নির্দেশেই সই হয়েছিল আদানির চুক্তি

প্রকাশিত: ৫:৫২ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৪
হাসিনার নির্দেশেই সই হয়েছিল আদানির চুক্তি

বর্তমান খবর,ডেস্ক রিপোর্ট ।। গত দেড় দশকে কোন জবাবদিহিতা ছাড়াই লাইসেন্স পেয়েছে ১০০-এর বেশি বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানি। কোম্পানিগুলোর সঙ্গে দরকষাকষি ছাড়াই হয়েছে প্রতিটি চুক্তি । প্রতিটি চুক্তিতেই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণব্যয় ও ক্যাপাসিটি চার্জ ধরা হয়েছে অনেক বেশি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের সবচেয়ে বেশি সমালোচিত চুক্তিটি হচ্ছে আদানির চুক্তি।

ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার জন্য ২৫ বছরের চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) চুক্তিটি সই করেছিল। চুক্তির খসড়া বিদ্যুৎ বিভাগে এলেও তা পিডিবিতে পাঠানো হয়নি। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া নিয়ে কাজ করা পিডিবির কর্মকর্তারা চুক্তির বিষয়ে আগে থেকে কিছুই জানতেন না। জানা গেছে তৎকালীন বিদ্যুৎ সচিব আহমদ কায়কাউসের সরাসরি তত্ত্বাবধানে চুক্তি সই হয়। তিনি আদানির সঙ্গে মিটিংয়ে ঢুকার আগেই পিডিবির কর্মকর্তাদের সতর্ক করেন, যেন চুক্তি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা না হয়। তিনি এও বলেন, কোনো বিষয় নিয়ে দরকষাকষি না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা নিজেই। বৈঠকে সচিব নিজে ক্যাপাসিটি চার্জের বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেন। সে সময় আদানির পক্ষ থেকে একটা রেট বলা হলে সচিব তা কিছুটা কমানোর অনুরোধ করেন। পরে সেটি গ্রহণ করা হয়। এভাবে দরকষাকষি ছাড়াই আদানির সঙ্গে চুক্তি সই হয়।
সূত্রমতে, আদানির সঙ্গে সইকৃত চুক্তিটি প্রায় পাঁচ বছর গোপন করে রাখা হয়। তবে বিদ্যুৎ আমদানি শুরুর আগে চুক্তির কপিটি পান পিডিবির কর্মকর্তারা। এতে দেখা যায়, দরকষাকষি ছাড়া চুক্তি সই করায় আদানিকে বেশকিছু বাড়তি সুবিধা দেয়া হয়েছে, যা দেশের অন্য কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র পাচ্ছে না। এর মধ্যে অন্যতম হলো কমপক্ষে সক্ষমতার ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কেনা। তা না হলে পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ ছাড়াও জরিমানা দিতে হবে।

এ বিষয়ে চুক্তির ৩.১-এর (বি) ধারায় বলা হয়েছে, পিডিবিকে চুক্তির প্রত্যেক বছর কেন্দ্রটির বিদ্যমান সক্ষমতার কমপক্ষে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনতে হবে, যা ‘মিনিমাম অফটেক কমিটমেন্ট’ হিসেবে বিবেচ্য হবে। যদি বাংলাদেশ তা কিনতে ব্যর্থ হয় তাহলে পিডিবির পক্ষ থেকে আদানি পাওয়ারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এ ক্ষতিপূরণের মধ্যে থাকবে আদানির কয়লার দাম, কয়লা পরিবহন ব্যয়, বন্দরে কয়লা খালাস ব্যয় ও কয়লা হ্যান্ডলিং ব্যয়। পায়রা ও রামপালের বিদ্যুৎ নেয়ার জন্য এমন কোনো ন্যূনতম সীমা নেই। এই দুটির সঙ্গে আদানির চুক্তিও আরেকটি পার্থক্য হলো, পায়রা ও রামপাল চুক্তিতে হরতাল, যুদ্ধ বা আইন পরিবর্তনের মতো রাজনৈতিক ঘটনাকে ‘ফোর্স মেজার’ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ এ সময় কোনো কিছু ঘটলে উভয় পক্ষই একে অপরের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি পাবে। কিন্তু আদানি পাওয়ারের সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, এমন কোনো ঘটনায় বাংলাদেশ যদি বিদ্যুৎ না নিতে পারে, তবে ক্যাপাসিটি চার্জ ও জরিমানাসহ সব ধরনের পাওনা তাদের দিতেই হবে। কিন্তু একই কারণে যদি আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারে, তবে পিডিবিকে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ দিতে তারা বাধ্য নয়।
চুক্তির আরেকটি অযৌক্তিক ধারা হলো, যদি রাজনৈতিক কোনো কারণে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেটা মেরামত ও এই সংশ্লিষ্ট সব ব্যয় পিডিবিকে দিতে হবে। রামপাল বা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এই সম্পূরক খরচ দিতে হবে না। আদানির জন্য আরেকটি সুবিধাজনক ধারা হলো, গ্রিডে মোট বিদ্যুৎ সরবরাহ করার নির্ভরযোগ্য সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য প্রথমবারের পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করতে পারার সুযোগ।
মানসম্পন্ন চুক্তিতে এ পরীক্ষা একবারই করা হয় এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে তাকে জরিমানা দিতে হয়। গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে আদানি পাওয়ার নিজস্ব খরচে আরেকটি পরীক্ষা করতে পারবে। নতুন পরীক্ষায় যদি প্রত্যাশিত রিডিং পাওয়া যায়, তবে তারা আগে পিডিবিকে দেয়া ক্ষতিপূরণের টাকাও ফেরত নিতে পারবে।

চুক্তির শর্তানুসারে, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বাড়তি সুবিধা এখানেই শেষ নয়। এক্ষেত্রে যদি আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ দিতে প্রস্তুত থাকে, তবে পিডিবি কোনো কারণে চাহিদা দিয়েও সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ না কেনে, তবুও আদানি কয়লার পুরো মূল্যই পাবে। তবে কয়লার দাম দিলেও এর মালিকানা পিডিবি পাবে কি না, তা চুক্তিতে বলা হয়নি।

এদিকে গড্ডার বিদ্যুৎকেন্দ্রের এলাকাকে ভারত সরকার ‘এসইজেড’ (বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল) ঘোষণা দেয় ২০১৯ সালে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে সব ধরনের শুল্ক-কর ছাড় পাচ্ছে আদানি। এতে কমবে ক্যাপাসিটি চার্জ ও কয়লা আমদানি ব্যয়। চুক্তির ১৩.১-এর (ই) ধারায় বলা হয়েছে, আদানি পাওয়ার অ্যাজাম্পশনগুলো (ট্যাক্স ও ভ্যাটের হার) কোনো পরিবর্তন হলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) জানাবে। যদিও তা করেনি আদানি। মূলত বাড়তি ক্যাপাসিটি চার্জ ও কয়লার দাম নেয়ার জন্য প্রতারণা করেছে কোম্পানিটি।

আদানির সঙ্গে সম্পাদিত বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি (পিপিএ) ঘেঁটে দেখা যায়, চুক্তির ১৩.২-এর (সি) ধারায় ক্যাপাসিটি চার্জের কথা বলা হয়েছে। ক্যাপাসিটি চার্জের হার লেখা হয়েছে পিপিএ’র শেষে শিডিউল-৬-এর টেবিল-এ তে। পিপিএ’র ১৩.১-এর (ডি) ধারায় শর্ত দেয়া হয়েছে, ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হবে কতগুলো অ্যাজাম্পশনের (শর্ত) ভিত্তিতে, যার একটি কর ও শুল্ক সংক্রান্ত। আর কর ও শুল্ক ভারতের করহার নীতির ওপর নির্ভরশীল থাকবে।

ভারতীয় গণমাধ্যমের তথ্যমতে, এসইজেড ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আদানি পাওয়ার সব ধরনের যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য আদানি মোট আটটি দেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে, যার মধ্যে রয়েছে চীন, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, জার্মানি, সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও গ্রিস। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ৯৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ যন্ত্রপাতি চীন থেকে আমদানি করে আদানি।

এদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কয়লা আমদানিতে শুল্ক ও সব ধরনের কর ছাড় পেয়েছে আদানি। এছাড়া কোম্পানিটিকে কোনো ধরনের গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স (জিএসটি), সারচার্জ বা অন্য কোনো শুল্ক-কর দিতে হবে না। সূত্রমতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় চললে বছরে লাগবে সাত থেকে ৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা। ফলে শুধু কয়লা আমদানিতেই আদানি শুল্ক-কর ছাড় পাচ্ছে ২০০ মিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে ভারতের রাজ্য সরকার কার্বন নিঃসরণের জন্য প্রতি টন কয়লার ওপর ৪০০ রুপি বা চার দশমিক ৮৮ ডলার কার্বন ট্যাক্স আরোপ করে। এ ট্যাক্সও ছাড় পেয়েছে আদানি। বছরপ্রতি আট মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা ধরলে বছরে কোম্পানিটি ছাড় পাবে প্রায় ৩৯ দশমিক শূন্য দুই মিলিয়ন ডলার। আর ২৫ বছরে তারা ছাড় পাবে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।

ভারতের সংবাদমাধ্যম আরও জানিয়েছে, এসইজেড ঘোষণার ফলে আদানির গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রথম পাঁচ বছর শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। পরবর্তী পাঁচ বছর তারা পাবে ৫০ শতাংশ শুল্ক ছাড়।
তথ্যমতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির যন্ত্রপাতির জন্য আদানির সাড়ে ১২ শতাংশ কাস্টম শুল্ক ও আবগারি শুল্ক, নির্মাণ কাজের জন্য ১৫ শতাংশ সার্ভিস ট্যাক্স, ঝাড়খণ্ডের বাইরে থেকে পণ্যসামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে দুই শতাংশ কেন্দ্রীয় বিক্রয় শুল্ক, ঠিকাদারের বিলের ৪০ শতাংশের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কম্পোজিট ট্যাক্স, সাড়ে পাঁচ শতাংশ ভ্যাট, নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য এক শতাংশ কল্যাণ ট্যাক্স, চার শতাংশ কর্মচুক্তি ট্যাক্স, ঝাড়খণ্ডের রাজ্য সরকারকে পানির ব্যবহার চার্জ ও আয়কর দেয়ার কথাও ছিল। তবে এসব শুল্ক ও কর মওকুফ পেয়ে গেছে আদানি। তবে বিদ্যুৎ বিক্রির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কোনো ছাড় দিচ্ছে না আদানি।

আদানির কেন্দ্রটির জন্য পিডিবিকে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ৩৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার। বিদ্যুৎ না কিনলেও এ অর্থ দিতে হবে। এ হিসাবে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে ৪৭৩ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার। আর ২৫ বছরে এ চার্জ বাবদ ব্যয় হবে প্রায় ১১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার।

সূত্রঃ শেয়ারবিজ