জাতীয়তাবাদ ও জাতীয়তাবাদী

প্রকাশিত: ১:৪৯ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৪
ছবিতে যাদের দেখছেন তারা হলেন বাংলার বিপিন চন্দ্র পাল, পাঞ্জাবের লালা লাজপত রায়, মহারাষ্ট্রের বাল গঙ্গাধর তিলক এই ট্রিওমায়ারেট লাল বাল পাল নামে খ্যাত। ভারতীয় উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদ বিকাশের মূল নায়ক তারাই।

আজ জাতীয়তাবাদী ভাইদের নিয়ে কিছু তিক্ত কথা লিখবো। আপনাদের আস্ফালন দেখে আর চুপ থাকতে পারলাম না। কথা গুলো তিক্ত হতে পারে তবুও আপনি যদি জাতীয়তাবাদী হয়ে থাকেন তাহলে পড়লে আশাকরি কিছু জানতে পারবেন।

জাতীয়তাবাদ কী? ভারতীয় উপমহাদেশে কারা মানুষের মাঝে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করেছেন? বাংলার প্রথম জাতীয়তাবাদী প্রথম সারির নেতা কে? বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী ধারণার পুনঃ প্রবর্তকের উপস্থাপন করা দফা গুলো কী কী?

কতজন আছেন এই প্রশ্নের মুখোমুখি নিজেকে একবার দাড় করিয়েছেন? সব প্রশ্নের উত্তর দেবো তার পূর্বে আপনাদের আস্ফালনের ব্যাপারে কিছু কথা বলে নেই।

বাংলাদেশে অনেক দলের নামের সাথে জাতীয় যুক্ত থাকলেও একটি দল তাদের নামের সাথে জাতীয় না লাগালেও লেখেন জাতীয়তাবাদী। সংক্ষেপে বিএনপি লেখার কারনে অনেক তৃণমূল কর্মী তাদের দলের পূর্ণ নাম শুনলে চিনতেও পারেন না। তারা জানেনা জাতীয়তাবাদ আসলে কি? তারা মনে করে নামে কি আসে যায় এটাও অন্য সকল দলের মত একটা রাজনৈতিক দল। শুধু তাই নয় এই দলের অনেক নেতারাও জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ জ্ঞান রাখেন বলে ধারণা করতে কষ্ট হয়। অনেকের দরকার চেয়ার, অনেকের দরকার কমিটি, আবার অনেকে তো কমিটি দেয়ার নামে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মত ব্যাংক লেনদেন করেন। তৃনমুলের নেতা হতে চাওয়া কর্মীরাও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির চেয়ে তেল মালিশের রাজনীতির প্রতিযোগিতায় প্রতিনিয়ত সামিল হচ্ছেন। তাদের আচরণ দেখে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি এরা নাকি আবার জাতীয়তাবাদী।

হে জাতীয়তাবাদী নেতারা নিজেকে প্রশ্ন করুন আপনি জাতীয়তাবাদের সাথে মশকরা করছেন নাতো?

⁉️ জাতীয়তাবাদ কি?

জাতীয়তাবাদঃ
জাতীয়তাবাদ এমন একটি ধারণা যা জাতিকে রাষ্ট্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে । এটি একটি নির্দিষ্ট জাতির স্বার্থকে উন্নীত করার প্রবণতা, জাতির সার্বভৌমত্ব ( স্ব-শাসন ) অর্জন ও বজায় রাখার লক্ষ্যে একটি জাতি রাষ্ট্র গঠন করে। বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত একটি জাতি একটি রাষ্ট্রের জন্য একটি প্রাকৃতিক এবং আদর্শ ভিত্তি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার একমাত্র সঠিক উৎস । এর আরও লক্ষ্য হল সংস্কৃতি , জাতিসত্তা , ভৌগলিক অবস্থান , ভাষা , রাজনীতি (বা সরকার ), ধর্ম , ঐতিহ্য এবং বিশ্বাসের মতো ভাগ করা সামাজিক বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ের ভিত্তিতে একটি একক জাতীয় পরিচয় গড়ে তোলা এবং বজায় রাখা। একটি একক ইতিহাস এবং জাতীয় ঐক্য বা সংহতি প্রচার করা। জাতীয়তাবাদ একটি জাতির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ ও লালন করতে চায়।

⁉️ ভারতীয় উপমহাদেশে কারা মানুষের মাঝে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করেছেন?

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনেক আগে থেকেই জাতীয়তাবাদ নিয়ে সোচ্চার হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৫৭ পরবর্তী জাতীয়তাবাদের উত্থান হতে শুরু করে যা পরবর্তীতে ১৯০৫ সালে স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্নতা লাভ করে। বাল গঙ্গাধর তিলক, বিপিন চন্দ্র পাল, লালা লাজপত রায়, ভিও চিদাম্বরম পিল্লাই, শ্রী অরবিন্দ, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এই আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে কয়েকজন। এছাড়াও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

⁉️ বাংলার প্রথম জাতীয়তাবাদী প্রথম সারির নেতা কে?

বাংলায় রাজনারায়ণ বসু ও অশ্বিনীকুমার দত্তের হাত ধরে দেশে বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের সূত্রপাত ঘটে। বিপ্লববাদের একজন প্রথম সারির নেতা ছিলেন বালগঙ্গাধর তিলক (১৮৫৭-১৯২০), পরবর্তীকালে যিনি পরিচিত হন ‘লোকমান্য তিলক’ নামে।
১৮৯৭ সালে রাজদ্রোহিতার অভিযোগে সরকার তাঁকে কারারুদ্ধ করে। তিনি হয়ে ওঠেন আত্মত্যাগ ও নব্য জাতীয়তাবাদী চেতনার মূর্ত প্রতীক।

বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী ধারণার পুনঃ প্রবর্তকের উপস্থাপন করা ধারাগুলো কী কী?

বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী চেতনা পুনঃ প্রবর্তন করেন বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করেন।

১৯ দফা সমূহ

১. সর্বোতভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। ২. শাসনতন্ত্রের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের সমাজতন্ত্র জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলন করা। ৩. সর্ব উপায়ে নিজেদেরকে একটি আত্বনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলা। ৪. প্রশাসনের সর্বস্তরে, উন্নয়ন কার্যক্রম এবং আইন-শৃংখলা রক্ষার ব্যাপারে জনসাধারনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ৫. সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ তথা জাতীয় অর্থনীতিকে জোরদার করা। ৬. দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণ করা এবং কেউ যেন ভুখা না থাকে তার ব্যবস্থা করা। ৭. দেশে কাপড়ের উৎপাদন বাড়িয়ে সকলের জন্য অন্তত মোটা কাপড় সরবরাহ নিশ্চিত করা। ৮. কোন নাগরিক গৃহহীন না থাকে তার যথাসম্ভব ব্যবস্থা করা। ৯. দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা । ১০. সকল দেশবাসীর জন্য ন্যূনতম চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা। ১১. সমাজে নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতষ্ঠা করা এবং যুব সমাজকে সুসঙ্গহত করে জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করা। ১২. দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারী খাতে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দান। ১৩. শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি সাধন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে সুস্থ শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। ১৪. সরকারি চাকুরীজীবিদের মধ্যে জনসেবা ও দেশ গঠনের মনোবৃত্তিতে উৎসাহিত করা এবং তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন করা। ১৫. জনসংখ্যা বিস্ফোরন রোধ করা। ১৬. সকল বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলির সাথে সম্পর্ক জোরদার করা। ১৭. প্রশাসন এবং উন্নয়ন ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকাররে শক্তিশালী করা। ১৮. দুর্নীতিমুক্ত ন্যায়নীতিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা। ১৯. ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ন সংরক্ষণ করা এবং জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুদৃঢ় করা।

আশা করবো যারা নিজেদের জাতীয়তাবাদী আদর্শের দাবী করেন তারা ক্ষমতার মসনদের স্বপ্ন দেখেতে দেখতে সাধারন মানুষের সাথে ক্ষমতার আস্ফালন দেখাবেন না।

মাহ্তাবুর রহমান
গণমাধ্যমকর্মী
mahtabur0@gmail.com