পুলিশের বাধা ও প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে

সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন

প্রকাশিত: ২:০৩ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২, ২০২৪

ডেক্স রিপোর্ট:

পুলিশের বাধা ও প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালন করেছে সারাদেশের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার সারাদেশে এই কর্মসূচি পালন করা হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা কোটা আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে নীরবতা পালন করে। কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবক ও পেশাজীবীরাও অংশ নেন। শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও মহাসড়ক অবরোধে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে। সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা, গণপ্রেপ্তার, হামলা-মামলা, গুম-খুন ও শিক্ষকদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলার প্রতিবাদ, জাতিসংঘের মাধ্যমে তদন্ত করে বিচার এবং ছাত্রসমাজের ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সারাদেশে এই কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। ময়মনসিংহে গতকাল নগরের টাউন হল এলাকায় শিক্ষার্থীরা এই কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল সড়কের প্রবেশমুখে টাউনহল এলাকার সড়কে বিক্ষোভ করেন তারা। কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগে পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

বেলা সোয়া ১১টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক গোকূল সূত্রধর মানিক, আনোয়ার হোসেন ও আরিফুল ইসলামের নেতৃত্বে ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থী সমাবেশস্থলে আসেন। পুলিশ তাদের সরে যেতে বলে। তখন পুলিশের সঙ্গে তাদের বাগবিতণ্ডা হয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে প্রধান সমন্বয়ক আশিকুর রহমান মিছিল নিয়ে আসেন। আনন্দ মোহন কলেজে যাওয়ার সড়কের মুখে মিছিল আটকে দেয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। তবে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা টাউন হল চত্বরে আসেন। বেলা একটার দিকে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে দুই মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। কর্মসূচি চলাকালে সড়কে এঁকে দেওয়া হয় প্রতিবাদী স্লোগান। শিক্ষার্থীদের হাতে ছিল ফেস্টুন। কবিতায়, গানে, কথায় প্রতিবাদ চলতে থাকে। হত্যার বিচার, নির্যাতনের বর্ণনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন বক্তারা। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকেরা এতে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য দেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক গোকূল সূত্রধর মানিক বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা আজ একা নন। অভিভাবক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, আইনজীবী সবাই আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। তাই শিক্ষার্থীদের কোনো ভয় নেই। আমরা নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হতে যাচ্ছি।’ আন্দোলনে অংশ নেওয়া ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্ট কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী নাইয়ান শাহরিয়ার বলেন, ‘যে ভাইয়েরা শহীদ হয়েছেন, তাদের স্মরণ করতে আজ আমরা এখানে জমায়েত হয়েছি। আমাদের শিক্ষকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। রাজপথে এসেছি এসবের প্রতিবাদ করতে।’

কর্মসূচিতে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী নাফিয়া খন্দকার। তিনি বলেন, ‘শুরুতে পুলিশ নিষেধ করেছিল, কর্মসূচি করতে দেয়া হবে না। কিন্তু আমাদের ভাইয়েরা অন্য কোথাও জমায়েত হয়ে একসঙ্গে মিছিল নিয়ে আসে। পুলিশ আটকাতে পারেনি। হত্যাকাণ্ডের বিচার ও আমাদের দাবি আদায়ের জন্য কর্মসূচি করেছি।’ কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে সারাদেশে নির্বিচার হত্যা, ছাত্র-শিক্ষকদের গ্রেপ্তার, হয়রানি ও নিপীড়নের প্রতিবাদে কুড়িগ্রামে আয়োজিত শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলে বাধা দিয়েছে পুলিশ। গতকাল দুপুর ১২টায় ‘সাধারণ শিক্ষার্থী কুড়িগ্রামের’ ব্যানারে এ কর্মসূচির আয়োজন করা
হয়। কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবক ও পেশাজীবীরাও অংশ নেন।

পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠ থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে প্রধান প্রধান সড়ক ঘুরে কলেজ মোড়ে বিজয় স্তম্ভের সামনে সমাবেশের কথা ছিল শিক্ষার্থীদের। কিন্তু পুলিশ তাদের সড়কে উঠতে দেয়নি। পরে বৃষ্টিতে ভিজে বিদ্যালয়ের মাঠেই বিক্ষোভ সমাবেশ করেন তারা। এর আগে বেলা ১১টা থেকে কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টার পর ব্যানার ও পোস্টার নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। এ সময় বিদ্যালয় ফটকে ব্যারিকেড দিয়ে পুলিশ মিছিলে বাধা দেয়। শিক্ষার্থীরা পুলিশের বাধায় সামনে এগোতে পারেননি। এ সময় পুলিশকে উদ্দেশ করে ভুয়া ভুয়া স্লোগান দিতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। পরে বৃষ্টি শুরু হলে তারা বৃষ্টিতে ভিজে বিদ্যালয়ের মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। কর্মসূচিতে অনেক অভিভাবক ও সাধারণ পেশাজীবী অংশ নেন। অভিভাবক পার্বতী রানী বলেন, ‘আমার ছেলে আজ বিক্ষোভ মিছিলে এসেছে। একজন মা হিসেবে আমি বাসায় বসে থাকতে পারিনি। তাই ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলকে সমর্থন জানিয়ে আমি নিজেও অংশ নিয়েছি।’

গাইবান্ধায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা গতকাল জেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কয়েকশ’ শিক্ষার্থী বেলা ১১টার দিকে জেলা শহরের বাস টার্মিনাল এলাকার একটি পেট্রোল পাম্পের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। সংহতি জানিয়ে আইনজীবীরা অংশ নেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। পরে শিক্ষার্থীরা পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে মিছিল নিয়ে শহরের দিকে এগোতে থাকেন। তারা শহরের পলাশপাড়া মোড় এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ আবারও বাধা দেয়। পুলিশের বাধায় শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে ফিরে বাস টার্মিনাল এলাকার আরেকটি পেট্রোল পাম্পের সামনের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এ সময় আশপাশের লোকজন আতঙ্কে দোকানপাট বন্ধ করেন। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ, র‌্যাব সহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিক্ষোভকারীদের চারপাশে ঘিরে রাখে।

একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বেলা ২টার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়। তবে এ ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। গাইবান্ধা সদর থানার ওসি মাসুদ রানা বলেন, বিক্ষোভকারীরা সড়কে একত্র হয়ে বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করতে থাকেন। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

তুমুল বৃষ্টি উপেক্ষা করে নোয়াখালীতে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালন করছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গতকাল বেলা পৌনে ৩টা থেকে শিক্ষার্থীরা নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদীর মোহাম্মদিয়া মোড় এলাকায় অবস্থান নেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে শহরের প্রধান সড়কে যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি দেখে অধিকাংশ যানবাহন আশপাশের বিকল্প সড়ক ব্যবহার করে। অপরদিকে পুলিশের একাধিক দলকে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির স্থলের আশপাশে সতর্ক অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

কর্মসূচি চলাকালে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, কর্মসূচি স্থলে আসার পথে শহরের সোনাপুর শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীদের পুলিশ হয়রানি করছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের দাবির বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে নতুন নতুন আরও কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। পঞ্চগড়ে ৯ দফা দাবি আদায়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাধারণ শিক্ষার্থীরা জেলা শহরের তেঁতুলিয়া রোডের এলএসডি গুদাম মোড় থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি বের করে। মিছিল নিয়ে তারা শহরের শেরে বাংলা পার্ক মোড়ের দিকে যেতে শুরু করলে ইসলামবাগ এলাকায় পুলিশ তাদের বাধা দেয়। পরে শিক্ষার্থীরা জাতীয় মহাসড়কের পাশে রফিজল প্লাজার সামনে কিছুক্ষণ বিক্ষোভ করে।

‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচির ব্যানারে গতকাল দুপুরে হবিগঞ্জ শহরের প্রধান সড়ক প্রায় দুই ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি তারা শহরজুড়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন। তাদের এ কর্মসূচিতে জেলা সদরের বৃন্দাবন সরকারি কলেজসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন। শিক্ষার্থীদের এ উপস্থিতি শহরের প্রধান সড়ক অবরুদ্ধ হয়ে যায়। এ সময় পুরো শহরজুড়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতিতে দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা এ সড়ক দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ থাকে। এ সময় প্রধান সড়কে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীরা নানা স্লোগান দিতে থাকেন। পরে মিছিলকারীরা শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে শহরের বৃন্দাবন কলেজ এলাকায় গিয়ে তাদের এ কর্মসূচি সমাপ্ত করেন।

এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ আমাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি। এর অংশ হিসেবে আজ আমরা জড়ো হই। সরকার আমাদের ৯ দফা দাবি বাস্তবায়ন না করে দেশে শিক্ষার্থীদের ওপর নতুন করে গ্রেপ্তার, আটক ও নির্যাতন চালাচ্ছে। তাই আমরা এখন সরকারের পদত্যাগকে প্রধান দাবিতে পরিণত করেছি।’