রংপুরের সুলতানপুরকে বাল্যবিয়ে মুক্ত ঘোষণা

প্রকাশিত: ৬:০৩ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৩

বর্তমান খবর,রংপুর প্রতিনিধি: কাক ডাকা ভোর হতে সবুজ ক্ষেতে ছোটে কৃষাণ-কৃষাণীরা। সকালে বইখাতা নিয়ে বের হয় শিশুরা। মসজিদ আর মক্তব থেকে ভেসে আসে কোরআনের সুর। বিদ্যালয়ে শিশুদের কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার শপথ। গ্রামের মেঠোপথ সকল বয়সী শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে।

সবুজ-শ্যামল ধানক্ষেত,ছায়াঘেরা সড়কের ধারে ধারে পুকুর আর কাঁচা-পাকা সড়কে ছবির মতো অপরূপ সুলতানপুর। ছেলে-মেয়ে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সম্ভাবনাময় সোনালী স্বপ্ন বোনা হয় প্রতিনিয়ত। সাড়ে ৩শত বর্গমিটার আয়তনের গ্রামটি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার দূর্গাপুর ইউনিয়নে অবস্থিত।

সম্প্রতি সুলতানপুর গ্রামকে বাল্যবিয়ে মুক্ত গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করেছে উপজেলা প্রশাসন। গত ৬ মাসে সুলতানপুর গ্রামে কোনো বাল্যবিয়ে হয়নি। যা জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সরকারি কর্মকর্তাদের নজরে আসে। প্রশংসায় ভাসছেন গ্রামের অভিভাবকমহল। খুশি স্কুল-কলেজপড়–য়া শিক্ষার্থীরাও। ফলে রংপুর জেলায় সুলতানপুর বাল্যবিয়ে মুক্ত মডেল গ্রামে পরিণত হয়েছে।

এ সাফল্য অর্জনের নেপথ্যে কাজ করছে ইউনিয়ন পরিষদ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও গ্রামবাসী। সকলের সম্বলিত উদ্যোগে সুলতানপুর বাল্যবিয়ে মুক্ত গ্রামের এক অনন্য উদাহরণ। দূর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা যায়,সুলতানপুর গ্রামের ৯০ ভাগ পরিবার কৃষি নির্ভরশীল। উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, ফসলের ভালো জাত না থাকা এবং উৎপাদনের আধুনিক কলাকৌশল থেকে পিছিয়ে ছিল এ গ্রামের মানুষ। ফলে লোকসান আর অভাব-অনটনের যাতাকলে কৃষি নির্ভর পরিবারগুলোর ছেলে-মেয়েদের বাল্যবিয়ে দিতো। এতে করে পারিবারিক কলহ বৃদ্ধি, অল্প বয়সে গর্ভধারণ, বাচ্চা প্রসবে মায়ের অকাল মৃত্যু, অপুষ্ট শিশুর জন্মদানসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল।

সারাদেশের ন্যায় পনেরো বছরে বদলে গেছে এখানকার জনজীবন। কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামো উন্নয়নসহ জীবনমানের উন্নয়নের সঙ্গে বেড়েছে জনসচেতনতাও। বর্তমানে এ গ্রামের ১৬১টি পরিবারের মধ্যে ১৭টি ধনী, ৩০টি মধ্যবিত্ত, ১১টি নি¤œ মধ্যবিত্ত, ৩৭টি দরিদ্র ও ৬৬টি হতরিদ্র পরিবার রয়েছে। চলতি বছরের মার্চ থেকে ওয়ার্ল্ড ভিশন নামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা দূর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে শিশু ফোরাম গঠন করে। এসব পরিবারে ঝুঁকিপূর্ণ গ্রæপ হিসেবে ১২ থেকে ১৮ বছরের শিশু-কিশোরদের মধ্যে ৯ জন ছেলে ও ২৩ জন মেয়েকে চিহ্নিত করা হয়।

শিশু ফোরামের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের বাল্যবিয়ের নেতিবাচক দিক স¤পর্কে সচেতন করা হয়। পাশাপাশি অভিভাবকদেরও বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিক স¤পর্কে সচেতন করা, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে জনগণকে হটলাইন নম্বর স¤পর্কে জানানো, সচেতনতামূলক বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হয়। এছাড়াও গ্রামের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয় করা, মাসিক সভার আয়োজন, বাড়ি পরিদর্শন ও মাসিক প্রতিবেদনের অগ্রগতির ওপর ভিত্তি করে বাল্যবিয়ে মুক্ত গ্রাম ঘোষণার উদ্যোগ গ্রহণ নেওয়া হয়। শিশু ফোরামের এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে গত ৬ মাসের কোনো বাল্যবিয়ে হয়নি সুলতানপুর গ্রামে।

গ্রামের মানুষদের উৎসবকে আরো রঙিন করে তোলে ওয়ার্ল্ড ভিশন। শিশু-কিশোরদের নাচ, গান, বাল্যবিয়ে নিয়ে সচেতনতামূলক নাটক ও আলোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল এ উৎসব। আনন্দময় সেদিনের সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে গ্রামের হাটে বাজারে, চায়ের দোকানে, মসজিদ-মাদ্রাসায়, বিদ্যালয়ে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কাজ করছে সবাই। বাল্যবিয়ে মুক্ত গ্রাম গড়ার লক্ষ্যে গঠন করা শিশু ফোরামের সংগঠক তাসফিয়া আক্তার হৃদিতা বলেন, শিশু ফোরামের সদস্যরা স্বেচ্ছায় এলাকায় জরিপ করে ৩৫ জন শিশু বাল্যবিয়ের ঝুঁকি চিহিৃত করে।

শিশু-কিশোর ও তাদের অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে বাল্যবিয়ের কুফল বুঝানো হয়। ছেলে অথবা মেয়ে যে একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়ে পরিবারের অভাব-অনটন দূর করতে পারবে তা বুঝানোর ফলে অভিভাবকরা সচেতন হয়েছে। সুলতানপুর গ্রাম উন্নয়ন কমিটির সভাপতি নাজমুল হুদা বাবলু তালুকদার বলেন, আমাদের অনেক দিনের চেষ্টা সার্থক হয়েছে।

সুলতানপুর বাল্যবিয়ে মুক্ত গ্রাম হিসেবে ঘোষণা হওয়ায় এলাকাবাসী আনন্দিত। ওয়ার্ল্ড ভিশনের সহযোগিতায় আমাদের গ্রামের শিশুরা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে গণস্বাক্ষর অভিযান পরিচালনা করেছে। আমাদের গ্রাম বাল্যবিয়ে মুক্ত গ্রাম। এটা গ্রামের মানুষের জন্য আনন্দের ও গর্বের। দূর্গাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান বলেন, বাল্যবিয়ে রোধে এলাকার শিশুদের সার্বিক সহযোগিতায় নানা কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। সুলতানপুরের মতো পুরো ইউনিয়নকে বাল্যবিয়ে মুক্ত মডেল ইউনিয়ন করার জন্য চেষ্টা করব। মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রকিবুল হাসান বলেন, বাল্যবিয়ে হলে ওই প্রজন্মের পরের প্রজন্মকেও এর কুফল ভোগ করতে হয়।

সুলতানপুর গ্রাম রংপুর জেলার মডেল গ্রাম। এ মডেলকে ছড়িয়ে দিতে উপজেলা প্রশাসন কাজ করে যাবে।