রংপুরে বিভাগে চিকিৎসকের পদ শূন্য ৬৮৩টি,হাসপাতালগুলোতে বিঘিœত হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা

প্রকাশিত: ৩:৪২ অপরাহ্ণ, মে ১৬, ২০২৫

বর্তমান খবর,রংপুর ব্যুরো:

রংপুর বিভাগের গাইবান্ধা,কুড়িগ্রাম,লালমনিরহাট,নীলফামারী,রংপুর,ঠাকুরগাঁও,পঞ্চগড় ও দিনাজপুর জেলার ২ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৬৫টি। এসব হাসপাতালে চিকিৎসকের মোট পদ ১ হাজার ২১৪টি। কিন্তু বর্তমানে কর্মরত ৫৩১ জন, পদ শূন্য ৬৮৩টি। চাহিদার অর্ধেকেরও কম জনবল থাকায় হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা কার্যক্রম চরমভাবে বিঘিœত হচ্ছে। সেবাপ্রার্থীদের বাধ্য হয়ে বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে। এতে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করার পরও অনেকেই চিকিৎসার নামে প্রতারিত হচ্ছে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেন,কাঙ্খিত জনবল না থাকায় চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিভাগীয় পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, রংপুর ও দিনাজপুরে দুটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থাকার পাশাপাশি ঠাকুরগাঁও,পঞ্চগড়,দিনাজপুর,নীলফামারী,লালমনিরহাট,কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় রয়েছে একটি করে ২৫০শয্যার হাসপাতাল।

এছাড়াও নীলফামারীর সৈয়দপুর ও পঞ্চগড়ে রয়েছে ১০০ শয্যার হাসপাতাল। সেই সঙ্গে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সংখ্যা ৫০টি। এছাড়া বিশেষায়িত দুটি কুষ্ঠ এবং একটি টিবি হাসপাতাল ছাড়াও দুটি ছোট হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতালে চিকিৎসকের মোট পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ৬৮৩টি। সিনিয়র ও জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদ ৬৫৫ জনের থাকলেও কর্মরত আছেন ১৯৯ জন। শূন্য পদ ৪৫৬টি। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন ও ১ পৌরসভার মানুষ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকে। কিন্তু চিকিৎসক-সংকটের কারণে সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে চিকিৎসকেরা। সেবা নিতে এসে রোগীরা ফিরে যাচ্ছে।

হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা কাঁচাবাড়ি গ্রামের মাহাবুল ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, এটে চিকিৎসা নাই। সাত কিলোমিটার দূর থাকি হাসপাতালে আসনো। কিন্তু চিকিৎসা পাইনো না। এ্যালা রংপুর শহর যাওছি বড় ডাক্টার দেখার। চিকিৎসক যদি না থাকে, তাহলে হাসপাতাল বানে লাভ কি?

বদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আশিকুল আরেফিন বলেন, ৩২ চিকিৎসকের মধ্যে ১০ জনের পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। আরও পাঁচজন প্রেষণে অন্যত্র কাজ করেন। অর্ধেক জনবল দিয়ে বিশাল জনগোষ্ঠীর সেবা দিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। বদরগঞ্জের মতো একই চিত্র পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিরও। এখানে ১৯ জন মেডিকেল অফিসারের বিপরীতে ১০ জন এবং ১১ জন কনসালট্যান্টের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র পাঁচজন।

কান ও গলার ব্যথা নিয়ে পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা নিতে আসা উপজেলার তাম্বুলপুর গ্রামের গৃহবধূ নূরজাহান বেগম বলেন, কান ও গলায় খুব ব্যথা। কিন্তু এখানে নাক-কান-গলা রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। রংপুর মেডিকেলে যেতে বলেছে। সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছি। এখন রংপুর শহরে সিরিয়াল নিয়ে টাকা দিয়ে ডাক্টার দেখাতে হবে।

পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ তানভির হাসনাত রবিন বলেন, নাক-কান-গলা, সার্জন, মেডিসিনসহ ছয়জন বিশেষজ্ঞ ও ৯জন মেডিকেল অফিসারের পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। অর্ধেক জনবলের সাহায্যে চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। রোগীদের অভিযোগ থাকা স্বাভাবিক।

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার প্রায় সাড়ে আট লক্ষ মানুষের চিকিৎসাসেবার ভরসার আশ্রয়স্থল সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত রয়েছে মাত্র চারজন চিকিৎসক। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্স নেই। জনবল সংকটের মুখে অপারেশন থিয়েটার কার্যত অচল। ব্যাহত হচ্ছে জরুরি বিভাগের সেবাও। চিকিৎসা নিতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর অনেকেই ফিরে যাচ্ছে হতাশ হয়ে। চারজন চিকিৎসক নিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি যেন এখন নিজেই জরুরি সেবার অপেক্ষায় বসে আছে। চিকিৎসক ও জনবল সংকটে নিজেই রোগ্ন হয়ে পড়েছে হাসপাতালটি।

৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে আসে। ৩১৬টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ১১৭টি পদই শূন্য। এখানে ফার্মাসিস্ট নেই, এমনকি নেই অ্যাম্বুলেন্স চালানোর ড্রাইভার। রোগী আসছে প্রতিদিন, কিন্তু সেবা কোথায়? উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, ৯টি মেডিকেল অফিসারের মধ্যে ৫টি পদ শূন্য।

আবাসিক মেডিকেল অফিসারের চেয়ার বহুদিন ধরেই খালি। হোমিও চিকিৎসক প্রেষণে রয়েছেন। ১১টি জুনিয়র কনসালটেন্ট পদের ৯টি, ১৩টি সহকারী সার্জনের ১০টি এবং ১৭টি উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের সব পদ শূন্য। যা নিঃসন্দেহে ভয়াবহ সংকট।

এছাড়া পরিসংখ্যানবিদ,হেলথ এডুকেটর,মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব ও ফিজিও),কার্ডিওগ্রাফার, বাবুর্চি সবাই যেন নেই এর তালিকায়। ৮৫জন স্বাস্থ্য সহকারীর মধ্যে ৩১টি পদই ফাঁকা। শুধু চিকিৎসক নয়, সহায়ক ব্যবস্থাপনাও মারাত্মক দুর্বল হয়ে পড়েছে।

উপজেলা বিএনপির আহবায়ক বাবুল আহমেদ বলেন, প্রায় সাড়ে আট লক্ষ মানুষের চিকিৎসা দিতে মাত্র চারজন চিকিৎসক, এটা অমানবিক। তারা অনেক পরিশ্রম করেও রোগীদের যথাযথ সেবা দিতে পারছেন না। দ্রæত চিকিৎসক ও জনবল নিয়োগ জরুরি।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.দিবাকর বসাক বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ রোগী বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন। অথচ কাগজে-কলমে ২৩টি মেডিকেল অফিসার পদের মধ্যে মাত্র ৭ জন কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে দুজন প্রেষণে, একজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। বাস্তবে মাত্র চারজন চিকিৎসক দিয়ে এত বিপুল সংখ্যক রোগীর সেবা দেওয়া কার্যত অসম্ভব।

তিনি আরও বলেন, শূন্যপদের বিস্তারিত তালিকা ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। দ্রæত শূন্য পদগুলো পূরণ হলে চিকিৎসাসেবার মান অনেকটাই উন্নত হবে। এদিকে রংপুর বিভাগের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালেও রয়েছে চিকিৎসকসহ অন্যান্য জনবল-সংকট। ৬০০ শয্যার হাসপাতালকে ১ হাজার শয্যা করা হলেও চলছে পুরোনো জনবল দিয়ে। হাসপাতালটিতে প্রতিদিন গড়ে চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকে আড়াই থেকে ৩ হাজার রোগী।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ ২৯৯টি হলেও কর্মরত ২৬৭ জন। শূন্য পদ ৩২টি। ১ হাজার ২৫ নার্সের মধ্যে রয়েছে ১ হাজার ১৭ জন। এছাড়া তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর পদ ১৪৬ জনের থাকলেও কর্মরত আছেন ১০০ জন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর ৪৫২ জনের মধ্যে আছেন ২৬৪ জন।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। চিকিৎসকের চেম্বারে তিল ধারণের জায়গা নেই। সেখানে তারাগঞ্জের হাড়িয়ারকুঠি গ্রামের গৃহবধূ আনোয়ারা বেগম বলেন, চর্ম ও যৌন রোগের চিকিৎসা নিতে সিরিয়াল নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আট বছরের মেয়েটার পুরো শরীরে লাল লাল গোটা উঠছে। খুব জ্বালা করে। ভোরে বাড়ি থাকি বের হইছি। বাস, গাড়ি উঠি সকাল ৯টায় হাসপাতাল আলছি। হামার সিরিয়াল ১২০ নম্বর। এ্যালা ১১টা বাজে। মানুষ নড়োছে না। জানি না ডাক্তার দেখার পামো কি না।

রমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিন আড়াই হাজার রোগীর চাপ থাকে। জনবল সংকটের কারণে কাঙ্খিত সেবা নিশ্চিত করতে খুবই বেগ পেতে হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ে জনবলের চাহিদা পাঠানো হয়েছে।

এবিষয়ে রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের (স্বাস্থ্য) উপ পরিচালক ডা.ওয়াজেদ আলী বলেন, চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে অবগত করা হয়েছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে শূন্য পদের বিপরীতে চিকিৎসক নিয়োগ করা হবে।