
বর্তমান খবর,রংপুর ব্যুরো:
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। আয়তনে বড় সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় প্রায় সাড়ে আট লক্ষ মানুষের বসবাস। বিপুল জনগোষ্ঠীর আধুনিক চিকিৎসাসেবার ভরসার আশ্রয়স্থল সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। আর সেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত রয়েছে মাত্র চারজন চিকিৎসক। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্স নেই। জনবল সংকটের মুখে অপারেশন থিয়েটার কার্যত অচল। ব্যাহত হচ্ছে জরুরি বিভাগের সেবাও।
চিকিৎসা নিতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর অনেকেই ফিরে যাচ্ছে হতাশ হয়ে। চারজন চিকিৎসক নিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি যেন এখন নিজেই জরুরি সেবার অপেক্ষায় বসে আছে। চিকিৎসক ও জনবল সংকটে নিজেই রোগ্ন হয়ে পড়েছে হাসপাতালটি। প্রতিটি ওয়ার্ড,করিডোর আর বহির্বিভাগে রোগীর উপচেপড়া ভিড়। কিন্তু সেখানে নেই পর্যাপ্ত সেবা। অসহায় মানুষের মুখগুলো যেন প্রতিধ্বনিত করছে একই প্রশ্ন,ডাক্তার কই?

৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে আসে। ৩১৬টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ১১৭টি পদই শূন্য। এখানে ফার্মাসিস্ট নেই, এমনকি নেই অ্যাম্বুলেন্স চালানোর ড্রাইভার। রোগী আসছে প্রতিদিন, কিন্তু সেবা কোথায়?
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, ৯টি মেডিকেল অফিসারের মধ্যে ৫টি পদ শূন্য। আবাসিক মেডিকেল অফিসারের চেয়ার বহুদিন ধরেই খালি। হোমিও চিকিৎসক প্রেষণে রয়েছেন। ১১টি জুনিয়র কনসালটেন্ট পদের ৯টি, ১৩টি সহকারী সার্জনের ১০টি এবং ১৭টি উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের সব পদ শূন্য। যা নিঃসন্দেহে ভয়াবহ সংকট।
এছাড়া পরিসংখ্যানবিদ,হেলথ এডুকেটর,মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব ও ফিজিও),কার্ডিওগ্রাফার,বাবুর্চি সবাই যেন নেই এর তালিকায়। ৮৫ জন স্বাস্থ্য সহকারীর মধ্যে ৩১টি পদই ফাঁকা। শুধু চিকিৎসক নয়, সহায়ক ব্যবস্থাপনাও মারাত্মক দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন সময় দেখা যায়, বহির্বিভাগে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে শত শত রোগী। অনেকেই সকাল ৮টায় এসে দুপুর গড়িয়ে গেলেও ডাক্তার দেখাতে পারে না। কারও মুখে বিরক্তি,কারও চোখে ক্লান্তি।
হাসপাতালের করিডোরজুড়ে অসুস্থ মানুষ আর তাদের স্বজনদের উৎকণ্ঠা যেন জমাট বাঁধা হতাশায় রূপ নিয়েছে। জরুরি বিভাগে একটি চেয়ারে হেলান দিয়ে ছটফট করছিলেন অসুস্থ এক বৃদ্ধা। তার মেয়ে আয়েশা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, সকাল থেকে মাকে নিয়ে বসে আছি, ডাক্তার একবারও এসে দেখেননি। কাকে বলব? সবাই বলে ডাক্তার নাই, অপেক্ষা করেন। কিন্তু একজন বৃদ্ধা মানুষ কতক্ষণ এমন কষ্ট নিয়ে বসে থাকবে?
আরেক এক বৃদ্ধ রোগীর ছেলে আরিফুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,ভেবেছিলাম সরকারি হাসপাতালে অন্তত জরুরি বিভাগে একটু সাড়া পাওয়া যাবে। সরকারি হাসপাতাল হলেও কোনো দায়িত্ববোধ নেই কারও মধ্যে। এমন চিত্র শুধু একজন বা দুজন রোগীর নয়, সেখানে অপেক্ষমাণ শত শত রোগীর মুখে মুখে ঘুরছে একই অভিযোগ, একই আক্ষেপ ডাক্তার কই? এক প্রসূতি নারীর স্বামী আব্দুল আজিজ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গাইনি ডাক্তার নেই, বলছে ডেলিভারি সম্ভব না, বড় হাসপাতালে যেতে হবে। তা হলে এখানে হাসপাতাল রেখে কী লাভ? অপারেশন থিয়েটার কার্যত বন্ধ। নেই পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নেই সার্জন। ছোটখাটো অস্ত্রোপচারও বন্ধ হয়ে গেছে বহুদিন ধরে।
ইনডোরে রোগী ভর্তি থাকলেও অনেক সময় চিকিৎসা পাচ্ছে না নিয়মমাফিক। হরিপুর ইউনিয়নের আব্দুল লতিফ বলেন, এই হাসপাতাল থেকে একসময় আমার বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন, এখন আমার সন্তানের চিকিৎসা হচ্ছে না ডাক্তার না থাকার কারণে।
উপজেলা বিএনপির আহবায়ক বাবুল আহমেদ বলেন, প্রায় সাড়ে আট লক্ষ মানুষের চিকিৎসা দিতে মাত্র চারজন চিকিৎসক, এটা অমানবিক। তারা অনেক পরিশ্রম করেও রোগীদের যথাযথ সেবা দিতে পারছেন না। দ্রæত চিকিৎসক ও জনবল নিয়োগ জরুরি।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.দিবাকর বসাক বলেন,স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ রোগী বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন। অথচ কাগজে-কলমে ২৩টি মেডিকেল অফিসার পদের মধ্যে মাত্র ৭ জন কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে দুজন প্রেষণে, একজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। বাস্তবে মাত্র চারজন চিকিৎসক দিয়ে এত বিপুল সংখ্যক রোগীর সেবা দেওয়া কার্যত অসম্ভব। তিনি আরও বলেন, শূন্যপদের বিস্তারিত তালিকা ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। দ্রæত শূন্য পদগুলো পূরণ হলে চিকিৎসাসেবার মান অনেকটাই উন্নত হবে।